বিধান রিবেরু : মন ভালো নেই। অন্য সকলের মতোই শুধু মৃত্যুর কথা শুনি। মহামারির ভেতর আতঙ্কে থাকি। ফেসবুকের নিউজ ফিডে চোখ বুলাই। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকা সংখ্যাগুলোর দিকে শঙ্কা নিয়ে তাকাই। আর জোর করে বাস্তবতা ভুলে থাকার চেষ্টা করি। এর মাঝেই খবর দেখি লকডাউনের কারণে দেশে দেশে পারিবারিক কলহ বেড়ে গেছে, বিশেষ করে স্বামীর হাতে স্ত্রীরা নিপীড়িত হচ্ছেন। নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে গেছে। এসব খবর সাংবাদিকরা নিষ্ঠার সাথে আমাদের জানিয়ে যাচ্ছেন। এর মাঝেই হঠাৎ করে চোখে পড়ে, যে সাংবাদিকরা অন্যের অনৈতিক ও অন্যায় কাজের সংবাদ পরিবেশন করেন, তাদেরই একজন আজ সে অপরাধে অপরাধী এবং সেই অপরাধের শিকারও একজন সাংবাদিক।
সাংবাদিকতা শিক্ষায় একটি বিষয় খুব গুরুত্বের সাথে পড়ানো হয়- এথিকস বা নীতি। নীতিচর্চার বিষয়টি মূলত নিজের সাথে নিজের চুক্তি, সমাজের ভালো ও মঙ্গলের সাপেক্ষে। এই চুক্তিই আপনাকে নিয়ে যাবে আলোর পথে, শুভ বুদ্ধির দ্বারা আপনি নীত হবেন, সমাজে আপনার স্থান নেতৃস্থানীয় হবে। সাংবাদিকরা সমাজে নেতৃস্থানীয়ই বটে। তাদের কথা মানুষ বিশ্বাস করে, আমলে নেয়। এমনকি অন্যায় ও অন্যায্য কিছু হলে তাদের কাছেই মানুষ প্রতিকার চায়। কিন্তু শর্ষে ফুলের ভেতরই যখন ভূত থাকে তখন? তখন যদি সেই ভূত তাড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে তাকেই বলে নৈতিকতা বা ম্যুরাল। সাংবাদিক সমাজে সেই নৈতিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন হলো অপরাধী সাংবাদিকের নাম ও পরিচয় প্রকাশ করে এবং যিনি নির্যাতনের শিকার তার পক্ষ নিয়ে।
বলছিলাম সাজিদা ইসলাম পারুলের সাথে রেজাউল করিম প্লাবন যা করেছেন সেই প্রসঙ্গে। যৌতুক চাওয়া, মারধর, লুকিয়ে আবার বিয়ে করতে যাওয়া এবং ভ্রুণ হত্যা করা—সবটাই করেছেন প্লাবন। এগুলো ফৌজদারি অপরাধ। এর বিপক্ষে কোনো প্রমাণ তিনি হাজির করতে পারেননি।
কথা হলো পারুল কে? প্লাবনই বা কে? এই সমাজেরই মানুষ তারা। তাদের আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। তবে এই সমাজকে আমি চিনি, আমার অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে চিনি। যে সমাজে আমরা বাস করছি, সেটি কোন নারীবান্ধব সমাজ নয়। এখানে পুরুষরা নীতি ও নৈতিকতার চর্চা খুব কমই করে থাকেন। শুধু সাংবাদিক কেন, প্লাবনের মতো দুর্নীতিবাজ পাওয়া যাবে সমাজের অন্যান্য পেশার ভেতরেও। নারীকে তারা ব্যবহার করতে চায়, পণ্য মনে করে, কিন্তু মানুষ মনে করে না। যে সমাজে মহামারি ব্যবস্থাপনা নিয়ে ব্যঙ্গ করলে গ্রেপ্তার করা হয়, আর দিনের পর দিন নারীদের নিয়ে অশ্লীল কটূক্তি করলেও কিছু হয় না, বরং ব্যবসার পসার বাড়ে, সেই সমাজে প্লাবনের মতো পুরুষেরা জন্মাবেই। এই দায় আমাদেরই। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে নারী থাকলেই সেই রাষ্ট্রের নারীরা খুব স্বাধীন বা মর্যাদা নিয়ে চলবেন, এমনটা ভাবা ঠিক নয়। খবরের কাগজ খুললেই তো হাজারো পারুলের কথা দেখি।
কথা হলো অন্য পারুলদের কথা যদি সংবাদপত্রে উঠে আসতে পারে, তাহলে খোদ সংবাদকর্মী পারুলের খবরটি কেন চেপে রাখা হবে, যে পারুল নিজে এমন অনেক অপরাধ উন্মোচন করেছেন। চেপে রাখা হয়নি। এই যে চেপে রাখা হলো না, তাতেই ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা পেলো। নৈতিকতার মানদণ্ড ঠিক থাকলো। অভিযুক্ত যত ক্ষমতাবান সাংবাদিকই হোক না কেন, তার বিরুদ্ধে যে অন্য সংবাদকর্মীরা লিখে উঠতে পারলেন এবং টেলিভিশনের পর্দায় বলে উঠতে পারলেন, তাতেই আমি আশাবাদী হই। সাংবাদিকদের নিয়ে নানা অভিযোগ রয়েছে সমাজে। আমি জানি, পেছনে পেছনে তাদের সবাই “সাংঘাতিক” বলে গালি দেয়। সাধারণ মানুষ সমীহ করে আর ‘অসাধারণ’ যারা তারাও কিছুটা অস্বস্তি বোধ করে সাংবাদিকদের সম্পর্কে।
তবে এটা ভুলে গেলে চলবে না, সমাজের খারাপ খবরটি ঝুঁকি নিয়ে কিন্তু এই সাংবাদিকরাই প্রকাশ করে। যেন সমাজে মন্দ লোকের স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠা না পায়। অবশ্য আগের মতো কতটা হাত খুলে সাংবাদিকরা লিখতে পারছেন তা নিয়ে তর্ক আছে। সে তর্ক উহ্য না রেখেই বলছি, নিজেদের ভেতরকার ব্যক্তির ঘটনাকে যখন নৈর্ব্যক্তিক করে সমাজের সামনে হাজির করা হয়, তখন টানেলের অপর প্রান্তে আলোকবিন্দুর উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। প্লাবনের মতো পতিত পুরুষ ভেসে যাক, আর পারুল বোনদের চোখে ফুলের মতো হাসি ফুটুক, এটাই চাই।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র সমালোচক।