নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : মহামারী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন সাংবাদিক হুমায়ুন কবির খোকন। এই প্রথম প্রাণঘাতী ভাইরাসে দেশের একজন সাংবাদিক মারা গেলেন। তার মৃত্যুতে পরিবার-স্বজন, সাংবাদিক সমাজ ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ভারাক্রান্ত ও ব্যতিত।
এদিকে সাংবাদিক খোকনের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে হোম আইসোলেশনে রাখা হয়েছে।
আইসোলেশনে থেকে সদ্যপ্রয়াত বাবাকে নিয়ে নিজের ফেসবুক টাইমলাইনে বুধবার বিকালে একটি আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়েছেন ছেলে আশরাফুল আবির।
বাবাকে নিয়ে ছেলের আবেগঘন স্ট্যাটাসটি তুলে ধরা হল-
আমি ও আমার পরিবারের কাছে মনে হচ্ছে যে আমরা হয়তো কোনো বাজে স্বপ্ন দেখলাম। কিন্তু এইটা যে আসলেই বাস্তবেই হয়ে গেল আমরা এখনো বিশ্বাসই করতে পারছি না। আমার কাছে এখনো মনে হচ্ছে যেন একটা বাজে স্বপ্ন দেখে হয়তো ঘুমটা ভাঙল।
আমার বাবা অত্যন্ত সৎ, নিষ্ঠাবান, পরিশ্রমী একজন ব্যক্তি ছিলেন। যিনি সারাটি জীবনে হয়তো নিজের কথা কখনো ভাবেননি। আমাদের জন্যই হয়তো সারাটা জীবন উৎসর্গ করে গেলেন। এই করোনা সঙ্কটময় দিনেও তিনি ঝুঁকি নিয়ে প্রতিটা দিন অফিসে গিয়েছেন বাসায় এসেছেন।
আমি এই নিয়ে আমার বন্ধুদেরও বলেছিলাম যে আমরা খুব ভয়ে আছি। কারণ আমার আব্বু আর আপু দুইজন চাকরিজীবী। তারা প্রতিদিনই অফিসের গাড়ি দিয়েই অফিসে আসা-যাওয়া করেছেন। আমার বাবার ৩-৪ দিন ধরে কাঁশি হচ্ছিল।
পরিমাণটা দিন দিন বেড়েই চলছিল। আমার তখনই সন্দেহ হচ্ছিল। আমি বাবাকে বললাম আপনার করোনা হয়নি তো? সে হেসে বলল আরে ধুর বেটা টন্সিলের ব্যথা এইটা আগে থেকেই ছিল। ওই রকম কিছু না। কারণ তিনি চাচ্ছিলেন বাসায় থেকেই ট্রিটমেন্ট নিয়ে সুস্থ হতে। কারণ করোনা পজিটিভ হলে এলাকার ভেতর আতঙ্ক ছড়াবে।
এছাড়া লজ্জার ভয়ে বাবা তখনও এইটা সাধারণভাবেই দেখছিলেন। আমিও ভাবলাম যে হয়তো এইরকম জ্বর কাঁশি হয়তো। বাসায় ওষুধ আর গরম পানি খেলে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। আমি এই কয়দিন বাসায় সাধারণভাবেই কাটাচ্ছিলাম বিভিন্ন স্কিল ডেভেলপ করার জন্য অনেক কিছু শিখছিলাম।
কিন্তু বাবার কাঁশি বেড়েই চলছিল আম্মুও জ্বর অনুভব করতে শুরু করল তার দুই দিন আগে। তখন আমি ভয় পেয়ে গেলাম। আম্মুকে বললাম, করোনার নমুনা দুই একদিনের মধ্যেই নিয়ে আসতে। কিন্তু বাবার কাঁশি বেড়েই চলছিল। কাঁশির সঙ্গে সঙ্গে ফুসফুস মারাত্মকভাবে আক্রমণ করছিল মনে হচ্ছে। হয়তো বাবার গলায় চুলকাচ্ছিল।
আমি এর পরের দিন একটু দেরিতে উঠলাম দেখলাম আম্মু বাবাকে ভাতের জাউ রান্না করে খাওয়াচ্ছেন। হটাৎ দেখলাম বাবা যেন কেমন করছেন। মনে হলো অনেক কষ্ট পাচ্ছেন, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। ওই মুহূর্তে বাবা এই লড়াইয়ের সঙ্গে পেরে উঠতে পারেনি।
আম্মু বললেন সকালে অ্যাম্বুলেন্স খবর দেয়া হয়েছে। উত্তরার রিজেন্টে ব্যবস্থা করা হয়েছে। অ্যাম্বুলেন্স আসতেসে। আম্মু বলল তোর কাছে কি ভাংতি (খুরচা) টাকা আছে আমাকে দে তো। আমার কাছে ৩৫০০ টাকা ছিল আমি পুরাটাই আম্মুকে দিয়ে দিলাম সঙ্গে সঙ্গে। আমি ঘরে পড়ার জামা পরেই অ্যাম্বুলেন্সে উঠে গেলাম। কারণ আমার মনে হচ্ছিল এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে।
আমি ভাবলাম হাসপাতালে হয়তো অনেকেই থাকবে আব্বুর জন্য অফিসের লোক। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলাম আমি আর আম্মু ছাড়া পরিচিত কেউ নেই।কারণ লকডাউন থাকায় রাস্তায় তেমন গাড়ি চলে না। এছাড়া অনেকেই হয়তো লক্ষণগুলো বর্ণনা শুনে কেউ আসতে সাহস করছিল না।
এদিকে শাবান আঙ্কেল (সাংবাদিক নেতা শাবান মাহমুদ) সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল ওইখানে। ওনারা সর্বাত্মক চেষ্টাই করেছিল আইসিউইতে রেখে অক্সিজেন দেয়ার। কিন্তু ডাক্তার বলল তার পালস নেই এবং ব্রেনও অক্সিজেন নিচ্ছে না। ডাইরেক্টলি বলেননি যে বাবা আগেই মারা গেছে।
বলল আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি দোয়া করেন যদি ব্রেইন হটাৎ মিরাকেলভাবে কাজ করতে শুরু করে। রাত ১০টার দিকে আম্মুকে ওপরে ডাকল, শেষ বারের মতো দেখার জন্য। তখন আম্মু ফোনে কয়েকজনকে জানিয়ে দেয়।
এছাড়া নিউজ স্ক্রলগুলোতেও অফিশিয়ালি আপডেট দিয়ে দেয় যে বাবা আর নেই। এখন বাবার করোনা টেস্ট হওয়ার আগেই মারা গেছেন তাই এইটা অফিশিয়ালি বলা হয়নি। বলা হয়েছে যে করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন।
সবাই বাবার জন্য দোয়া করবেন যেন আল্লাহ ওনাকে জান্নাতবাসী করেন। ওনার মতো ভালো, সৎ এবং নিষ্ঠাবান মানুষ খুব কমই আছে সমাজে। এছাড়া আমি চাই না এখন সবাই আমাদেরকে ডিমোটিভেট বা ভয়ভীতি দেখাক। আমরা এমনিতেই অনেক কঠিন সময় পার করছি।
আমরা সবাই সতর্কতা অবলম্বন করেই বাসায় আছি। বাসা বা এলাকা হয়তো লকডাউন হতে পারে। তাই এই মুহূর্তে মনে করি সবাই আমাদের জন্য দোয়া করুক।
আমার বন্ধুরা অনেক চিন্তিত হয়ে পড়েছে আমার জন্য, আমাদের সামনের দিনগুলো নিয়ে। আশা করি আমাদের পরিবার, আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি ও বাংলাদেশ সরকার পাশে থাকবেন। বাস্তবতা কঠিন হয়ে গেছে। তবুও বাস্তবতার সঙ্গেই সবকিছু এখন এডজাস্ট করে নিতে হবে। সবাই ভালো থাকবেন এবং সচেতন হবেন। আপাতত আর কিছু লিখতে চাচ্ছি না।
প্রসঙ্গত, তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালে ভর্তি হন দৈনিক সময়ের আলোর নগর সম্পাদক ও চিফ রিপোর্টার হুমায়ুন কবির খোকন। ঘণ্টাখানেক পর তার মৃত্যু হয়। তখনই চিকিৎসকরা তার করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হওয়ার কথা বলেছিলেন। পরে তার নমুনা পরীক্ষায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া গেছে।