সাউথইস্ট ব্যাংকে নানা অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

নয়াবার্তা প্রতিবেদক : পরিচালকদের কর্তৃত্বের দ্বন্দ্বে আগে থেকেই অস্থিরতা চলছে সাউথইস্ট ব্যাংকে। চেয়ারম্যান পদকে কেন্দ্র করে দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন ব্যাংকটির পরিচালকরা। তাদের দ্বন্দ্বের বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনায়ও। এবার নতুন করে যুক্ত হয়েছে ব্যাংকটিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ। এরই মধ্যে সাউথইস্ট ব্যাংকের অনিয়ম খুঁজতে তদন্ত শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক বিভাগ। এর মধ্যে ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগের তদন্তে সাউথইস্ট ব্যাংকের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগসংক্রান্ত বিভিন্ন অনিয়মের ঘটনা উঠে এসেছে। এজন্য ব্যাংকটিকে ১০ লাখ টাকা জরিমানাও করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। শিগগিরই আরো জরিমানা ও শাস্তির মুখে পড়তে পারে দেশের বেসরকারি খাতের প্রথম সারির ব্যাংকটি।

টানা ১৭ বছর সাউথইস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করছেন আলমগীর কবির। ২০০৪ সাল থেকে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়, সাউথইস্ট ব্যাংক চেয়ারম্যানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি হলো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স। ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালনকারী আলমগীর কবির বীমা কোম্পানিটিরও উপদেষ্টা। ব্যাংক কোম্পানি আইন লঙ্ঘন করে সাউথইস্ট ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সীমাতিরিক্ত শেয়ার ধারণ করছে। এক্ষেত্রে কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করা হয়নি বলে মন্তব্য করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দল।

একই সঙ্গে সাউথইস্ট ব্যাংক চেয়ারম্যানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট আরেক বীমা কোম্পানি এশিয়া ইন্স্যুরেন্সেরও বিপুল পরিমাণ শেয়ার কিনেছে ব্যাংকটি। পর্ষদের অনুমোদন বা উপস্থাপন ছাড়াই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সব নির্দেশনা লঙ্ঘন করে আলমগীর কবিরের স্বার্থসংশ্লিষ্ট আরেক প্রতিষ্ঠান বিএলআই ক্যাপিটাল লিমিটেডকে ২০০ কোটি টাকার ঋণ দেয়া হয়েছে বলে পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ মার্চেন্ট ব্যাংক পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বে লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। এছাড়া ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে বিভিন্ন কোম্পানির আইপিও-পূর্ব প্লেসমেন্ট শেয়ার কেনা হলেও সেগুলো আইপিওতে আসেনি এবং ব্যাংক শেয়ারের মালিকানা পায়নি বলে চিহ্নিত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

সামগ্রিক বিষয়ে সাউথইস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম কামাল হোসেন বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরির্দশক দলকে আমরা সবসময়ই ব্যাংকে স্বাগত জানাই। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগসংক্রান্ত যেসব বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আপত্তি তুলেছে, আমরা সেগুলো সমাধান করার চেষ্টা করছি। আমরা ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কিনেছি চার বছর আগে।তখন পুঁজিবাজারে বীমা কোম্পানিটির শেয়ারদর ছিল ৩৮ টাকা। কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের দাম ২৫০ টাকার ঊর্ধ্বে উঠেছিল। এখন বাজারদর হিসাবে মূলধনের সীমা খুঁজলে সেটি সীমাতিরিক্তই দেখাবে।

ব্যাংক কোম্পানি আইনের ২৬ক ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংক তার মোট মূলধনের ৫ শতাংশের বেশি অর্থ দিয়ে নির্দিষ্ট কোনো কোম্পানির শেয়ার কিনতে পারবে না। অথচ সাউথইস্ট ব্যাংক তার মোট মূলধনের ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ অর্থ দিয়ে ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কিনেছে। আইন অনুযায়ী, বীমা কোম্পানিটির আদায়কৃত মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার সাউথইস্ট ব্যাংক কিনতে পারার কথা নয়। এক্ষেত্রেও ব্যাংকটি সীমা লঙ্ঘন করে ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের আদায়কৃত মূলধনের ২২ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ মূল্যের শেয়ার কিনেছে। ২০২০ সালের নভেম্বরে কোম্পানিটির শেয়ারধারণের অনুমোদিত সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করলেও নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে পরবর্তী মাসে ৭ লাখ ৫২ হাজার ৫৭টি শেয়ার কিনেছে সাউথইস্ট ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দলের কাছে এ বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেনি ব্যাংকটি।

সাউথইস্ট ব্যাংককে ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সীমাতিরিক্ত শেয়ার বিক্রি করে দিতে নির্দেশনা দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও শেয়ার বিক্রির ক্ষেত্রেও প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে ব্যাংকটি। চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ২৩ লাখ ৪০ হাজার শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানায় সাউথইস্ট ব্যাংক। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদন্ত করে দেখেছে, বিক্রয়কৃত শেয়ার ন্যাশনাল সিকিউরিটিজ অ্যান্ড কনসালট্যান্ট লিমিটেডে রক্ষিত সাউথইস্ট ব্যাংকের একটি হিসাব থেকে একই ব্রোকারেজ হাউজে রক্ষিত ব্যাংকেরই বিশেষ তহিবল হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছে। শেয়ারগুলো বিক্রি হলেও সেটির মালিকানায় কোনো পরিবর্তন হয়নি। ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার বিক্রির ক্ষেত্রে ছলচাতুরীর আশ্রয় নেয়ায় গত ২৬ অক্টোবর সাউথইস্ট ব্যাংককে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

সাউথইস্ট ব্যাংককে জরিমানার বিষয়টি জানিয়ে একই দিন চিঠি দেয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের অফ-সাইট সুপারভিশন বিভাগ থেকে। ওই চিঠিতে বলা হয়, চাতুরীর মাধ্যমে বিক্রি দেখানো ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ২৩ লাখ ৪০ হাজার শেয়ার ১৫ দিনের মধ্যে ওপেন মার্কেটে বিক্রি করতে হবে। এসব শেয়ার বিক্রির পরও কোম্পানিটিতে সীমাতিরিক্ত যে বিনিয়োগ থাকবে, সেটিও সমন্বয় করতে হবে। ওই সীমাতিরিক্ত বিনিয়োগ নির্ধারিত মাত্রায় নামিয়ে না আনা পর্যন্ত চিঠিটি পাঠানোর তারিখ থেকে প্রতিদিন ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা আরোপ ও আদায় করা হবে বলেও বাংলাদেশ ব্যাংক স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এশিয়া ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের ৪০ লাখ ৯৯ হাজার ১৪টি শেয়ার ধারণ করেছে সাউথইস্ট ব্যাংক। বীমা খাতের এ কোম্পানির ১৩ লাখ ৯৯ হাজার ৬২৩টি শেয়ারের মালিক সাউথইস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান আলমগীর কবির। একই সঙ্গে তার সন্তান রাইয়ান কবিরের মালিকানায়ও এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের ৫৫ হাজার ১২৩টি শেয়ার রয়েছে। রাইয়ান কবিরও সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিচালক।

চেয়ারম্যানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট আরেক প্রতিষ্ঠান বিএলআই ক্যাপিটাল লিমিটেডকে ২০০ কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে সাউথইস্ট ব্যাংক। যদিও এক্ষেত্রে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়, বিএলআই ক্যাপিটালকে দেয়া ঋণের বিষয়ে কোনো বিবরণ সাউথইস্ট ব্যাংক পর্ষদে উপস্থাপন করা হয়নি। এক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদের কোনো পূর্বানুমোদনও নেয়া হয়নি। ঋণটি দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো প্রজ্ঞাপনও অনুসরণ করা হয়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। আলমগীর কবিরের পুত্র ও সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিচালক রাইয়ান কবির বে লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের একজন শেয়ারধারক। প্রতিষ্ঠানটিকে দেয়া ২০০ কোটি টাকা ঋণের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত জামানতও রাখা হয়নি বলে মন্তব্য করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অন্যদিকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত সাউথইস্ট ব্যাংক বে লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের ১ কোটি ৪০ লাখ ১২ হাজার ৪০৬টি শেয়ার ধারণ করেছে।

২০১৮ সালের ২১ মে বিডি থাই ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড নামের একটি কোম্পানির আইপিও-পূর্ব ৬২ লাখ প্লেসমেন্ট শেয়ার কেনার জন্য ৮ কোটি ৬ লাখ টাকা দেয় সাউথইস্ট ব্যাংক। যদিও এখন পর্যন্ত সে শেয়ার ব্যাংকটি বুঝে পায়নি। ইএম পাওয়ার লিমিটেড নামের একটি কোম্পানির আইপিও-পূর্ব ১ কোটি ৫০ লাখ প্লেসমেন্ট শেয়ার কেনার জন্য ২২ কোটি ৫০ লাখ টাকা দিয়েছিল ব্যাংকটি। ২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর দেয়া সে টাকার বিনিময়ে এখনো শেয়ার বুঝে পায়নি সাউথইস্ট ব্যাংক। একইভাবে ভেঞ্চার ইনভেস্টমেন্ট পার্টনারস বাংলাদেশ লিমিটেড নামের একটি কোম্পানির শেয়ার কেনার জন্য ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা দিয়েছিল ব্যাংকটি। ২০০৭ সালে দেয়া সে অর্থের বিপরীতে ব্যাংকটি এখনো কোনো শেয়ার পায়নি বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরির্দশনে উঠে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা বলেন, কাগজে কলমে সাউথইস্ট ব্যাংকে একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকলেও ব্যাংক পরিচালনায় তার কার্যকর কোনো ক্ষমতা নেই। ১৭ বছর ধরে ব্যাংকটির নীতিনির্ধারণী ও ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্ত আলমগীর কবিরই নিয়েছেন। ব্যাংকের অর্থ তিনি নিজের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রীতিনীতি উপেক্ষা করে ব্যবহার করেছেন। শুধু পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাংকটির যেসব অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে, সেটি অপ্রত্যাশিত। সাউথইস্ট ব্যাংকের ঋণ বিতরণসহ অন্যান্য বিষয়েও বিশেষ পরিদর্শন চলছে।

Share