নয়াবার্তা প্রতিবেদক : স্থগিত করা পরীক্ষা বাতিলের পর চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেছে ১১টি শিক্ষা বোর্ড। ১৩টি বিষয়ের মধ্যে ৬টির পরীক্ষা বাকি থাকায় কোন পদ্ধতিতে ফল দেওয়া হবে, তা নিয়ে গতকাল বুধবার সব শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বৈঠকে বসেছিলেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সম্মেলন কক্ষে।
সেখানে প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে, পরীক্ষা না হওয়া বিষয়গুলোর ফল সংশ্লিষ্ট পরীক্ষার্থীর মাধ্যমিকের (এসএসসি) ফলের ভিত্তিতে বা সাবজেক্ট ম্যাপিং করে নির্ধারণ করা হবে। এ বিষয়ে প্রস্তাব তৈরি করে আজ বৃহস্পতিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন মিললে ফল তৈরির কাজ শুরু হবে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, সব বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বসেছিলেন। সেখানে সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে ফল তৈরির প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
তবে স্থগিত পরীক্ষাগুলো বাতিল করার সিদ্ধান্তে হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়েছে পরীক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ। অনেক অভিভাবকও সরকারের এ সিদ্ধান্তে খুশি নন। তারা ফের পরীক্ষা আয়োজনের দাবি জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখছেন। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, পরীক্ষা বাতিল করা সমস্যা সমাধানের ভালো বিকল্প নয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহও বলেছেন, তারা পরীক্ষা বাতিলের পক্ষে নন।
এ ছাড়া গতকাল রাজধানীর নটর ডেম কলেজসহ কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা নেওয়ার দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেছে। পরে তারা শিক্ষা উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি দেয়।
পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়ে খুশি নন খোদ শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদও। তিনি গতকাল বিকেলে নিজ মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এইচএসসির বাকি পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত আরও বিচার-বিবেচনা করে নিতে চেয়েছিলাম। তারা সচিবালয়ে ঢুকে যা করেছে তা দুঃখজনক।
ফল তৈরির প্রক্রিয়া : ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক মো. আবুল বাসার জানান, কীভাবে সাবজেক্ট ম্যাপিং করে ফল তৈরি করা হবে তা ঠিক করতে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করবে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটি।
গতকাল শিক্ষা বোর্ডগুলোর কর্মকর্তারা ফলাফল তৈরির বিষয়টি নিয়ে বৈঠক করেন। সেখানে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও সিস্টেম অ্যানালিস্টরা বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন। তার মধ্যে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য আলোচনা ছিল, অনুষ্ঠিত পরীক্ষাগুলোর নম্বর এবং যেগুলো হয়নি সেগুলোর সাবজেক্ট ম্যাপিং করে ফল প্রস্তুত।
সভায় অংশ নেওয়া কর্মকর্তারা জানান, কীভাবে সাবজেক্ট ম্যাপিং হবে, সেই বিষয়ে বিভিন্নজন বিভিন্ন মত দিয়েছেন। কেউ এসএসসির ফল দেখে ম্যাপিং করতে বলেছেন। আবার কেউ জেএসসি ও পিইসি পরীক্ষার ফলও পর্যালোচনার বিষয়টি তুলেছেন। বিষয়টি নিয়ে আরও বৈঠক করে একটি চূড়ান্ত প্রস্তাব প্রস্তুত করে তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে বৈঠকে।
ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক মো. আবুল বাসার বলেন, যে পরীক্ষাগুলো হয়েছে, সেগুলোর নম্বর এবং যে পরীক্ষাগুলো হয়নি, সেগুলোর সাবজেক্ট ম্যাপিং বা কোন উপায়ে ফল প্রকাশ করা যায়; সে বিষয়ে খসড়া প্রস্তাব পাঠাতে বোর্ডগুলোর পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও সিস্টেম অ্যানালিস্টদের বলা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে প্রস্তাব পেলে, আমরা তা যাচাই-বাছাই করে মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়ার পর ফল প্রকাশ করা হবে।
ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, যে পরীক্ষাগুলো হয়েছে, সেগুলোর নম্বর তো আমাদের হাতে আছে। যেগুলো হয়নি, সেগুলোর জন্য সাবজেক্ট ম্যাপিং করা যেতে পারে।
ব্যবহারিক পরীক্ষার নম্বর কীভাবে যুক্ত হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যে বিষয়ের পরীক্ষাগুলো হয়েছে, কিন্তু ব্যবহারিক পরীক্ষা হয়নি; ওই বিষয়গুলোর ব্যবহারিকের নম্বর সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে হতে পারে। আসলে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও সিস্টেম অ্যানালিস্টদের প্রস্তাব বা তাতে অনুমোদন পাওয়ার আগে এ বিষয়ে চূড়ান্ত কিছুই বলা যাচ্ছে না।
সভায় অংশ নেওয়া একাধিক পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক জানান, ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ফল সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছিল। ২০২১ সালেও তিনটি বিষয়ের পরীক্ষা নিয়ে অন্য বিষয়গুলোর ফল সাবজেক্ট ম্যাপিং করে দেওয়া হয়েছিল। আমাদের সামনে দুটি উদাহরণ রয়েছে। সে অভিজ্ঞতার আলোকে প্রস্তাব তৈরি করতে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকদের বলা হয়েছে।
পরীক্ষা বাতিল নিয়ে শিক্ষার্থীদের দুই মত : পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছে রাজধানীর নটর ডেম কলেজের পরীক্ষার্থীরা। এক বিজ্ঞপ্তিতে তারা বলেছে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা না করে একপক্ষীয়ভাবে পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তাই তারা এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল মেধার বিজয় সুনিশ্চিত করার জন্য। দেশে এখন পরীক্ষা না নিয়ে পরিশ্রমী শিক্ষার্থীদের মেধার যে অবমূল্যায়ন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা অযৌক্তিক।
অপরদিকে, নটর ডেম কলেজের ক্যাপ্টেনবৃন্দের পাঠানো বিবৃতিতে জানানো হয়, ‘সম্প্রতি নটর ডেম কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীদের নামে যেসব বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে, সেগুলোর সঙ্গে কলেজের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর কোনো সংযোগ নেই। তাই সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে আজ শিক্ষা উপদেষ্টার বিবৃতির পর সব গ্রুপে জনমত যাচাই করে ক্যাপ্টেনবৃন্দ একটি সাধারণ বিবৃতি প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
এই বিবৃতিতে বলা হয়, পরীক্ষাগুলো বাতিল করার যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে এবং যে পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থীদের একাংশ এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত না হলেও বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সিদ্ধান্ত মেনে নিতে প্রস্তুত। দেশব্যাপী দুর্যোগ এবং বিভিন্ন পক্ষের সহিংস কর্মকাণ্ড ঘটানোর আশঙ্কায় পাল্টা কোনো কর্মসূচি দিতে আমরা আগ্রহী নই।
শিক্ষার্থীরা বলেছে, শিক্ষা উপদেষ্টা আজ যে বিবৃতি দিয়েছেন, আমরা একেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বলে গণ্য করছি এবং স্বাগত জানাচ্ছি। এই সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীদের একাংশের মনে অসন্তোষের সৃষ্টি করলেও বৃহত্তর স্বার্থে আমরা আর কোনো পরিবর্তন চাই না।
‘কেউ উস্কানি দিচ্ছে কিনা, সেটাও ভাবার বিষয়’
গতকাল নিজ মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, যারা পরীক্ষা বাতিলের দাবি করেছে, তারা কয়েক হাজার। কিন্তু এর বাইরে সারাদেশে আরও ১২-১৩ লাখ পরীক্ষার্থী রয়েছে। তবে দেশের পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক নয়, সব কেন্দ্রে পরীক্ষা নেওয়ার উপযোগী নয় এবং প্রশ্নপত্রের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা রক্ষার চ্যালেঞ্জকেও বিবেচনায় নিতে হচ্ছে।
সচিবালয়ের ভেতরে শিক্ষার্থীদের ঢুকে পড়ার বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, তারা সচিবালয়ে ঢুকে যা করেছে, তা দুঃখজনক। এই পরিস্থিতি আরও কিছুদিন সামলাতে হবে। তিনি বলেন, ভেতর থেকে কেউ পরীক্ষার্থীদের এসব ঘটনায় উস্কানি দিচ্ছে কিনা, সেটাও ভাবার বিষয়।
চলতি বছরের স্থগিত হওয়া এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত রিভিউ হবে কিনা, সে সিদ্ধান্ত আন্তঃশিক্ষা বোর্ড নেবে বলে জানান উপদেষ্টা।
সংবাদ সম্মেলনে পাঠ্যবই ছাপানোর বিষয়ে কথা বলেন শিক্ষা উপদেষ্টা। তিনি বলেন, এ বছর বই ছাপাতে কোনো ধরনের দুর্নীতি হবে না। ইতোমধ্যে যেসব বই ছাপার দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল, তা বাতিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এবার বই ছাপার মান ও কাগজের মান ভালো হবে।
তিনি জানান, দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য (ভিসি) নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। সবার গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে ভিসি নিয়োগ করা হবে।
ক্ষমতার পালাবদলের পর বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি পদত্যাগ করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ এ পদটি ফাঁকা থাকায় প্রশাসনিক জটিলতা তৈরির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ অবস্থায় যোগ্য ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য শিক্ষকদের থেকে ভিসি নিয়োগের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো থেকেও অনেক শিক্ষককে পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। অনেকে আবার রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে নিজে থেকে সরে যাচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে উপদেষ্টা বলেন, দেশের বেসরকারি কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছিল। তাতে শিক্ষক নিয়োগে যে অনিয়ম হয়েছে, সেটা ছিল পুঞ্জীভূত অনিয়ম। অত্যন্ত অসংগত কারণে অনেককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এ রকম হাজার হাজার অভিযোগ আমার কাছে এসেছে। এগুলো নীতিগত সিদ্ধান্ত ছাড়া তো ঠিক করা যাবে না। তবে কথা হচ্ছে, শিক্ষাঙ্গনে ভদ্রতা বজায় রাখতে হবে, বল প্রয়োগ করা যাবে না।
গত ৩০ জুন সারাদেশে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা শুরু হয়। এতে পরীক্ষার্থী ছিল ১৪ লাখ ৫০ হাজার ৭৯০ জন। প্রথম দফায় প্রকাশিত রুটিন অনুযায়ী ৮ দিন পরীক্ষা হওয়ার পর কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে ১৮ জুলাইয়ের সব পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। এর পর আরও তিন দফায় পরীক্ষা স্থগিত করে সরকার। সূচি অনুযায়ী, ১৩ দিনের মোট ৬১টি বিষয়ের পরীক্ষা গ্রহণ বাকি ছিল।