নয়াবার্তা প্রতিবেদক : জেড আই খান পান্না। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। তিনি বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের বেশ কয়েকবারের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। মানবাধিকার সংগঠন ‘ব্লাস্ট’-এর প্রতিষ্ঠাকালীন এই সদস্য বর্তমানে ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’-এর চেয়ারপারসনের দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর মতে, “সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে জিয়া ও এরশাদের ‘হ্যাঁ না’ ভোটের চেয়েও খারাপ ভোট হয়েছে। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট অঘটন ও সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে পুলিশের হামলা নিয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে ।
- সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটল। একজন আইনজীবী হিসেবে বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
জেড আই খান পান্না : আমি বলব, আমাদের সব অর্জন বিসর্জন হলো। সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ এমন একটি স্থান, যেখানে গণতন্ত্রের চর্চা হয়ে আসছে, সংবিধান ও মানবাধিকার রক্ষার জন্য আন্দোলন হয়েছে। আইনজীবীদের মধ্যে যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ছিল, এই ঘটনায় তাও নষ্ট হয়ে গেল। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা,সংবিধানকে সমুন্নত রাখার কথা তো আইনজীবীরাই বলতেন। তারা মানবাধিকার রক্ষার কথা বলতেন। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথাও আইনজীবীরা বলতেন। সাবেক মন্ত্রী আবদুল মতিন খসরুর আইনজীবীদের নেতৃত্বে থাকা পর্যন্ত একটা ধারা ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ আর দেখা যায় না।
- এর পেছনে কি রাজনীতি আছে বলে মনে করেন?
জেড আই খান পান্না : রাজনীতি করার অধিকার সবার আছে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনকে অবশ্যই দলীয় রাজনীতির বাইরে রাখতে হবে। বুধ ও বৃহস্পতিবার যা ঘটল, সামরিক শাসনামলেও তা ঘটেনি। এ জন্য আমি ব্যথিত ও মর্মাহত।
- আগে তো সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবীদের একটা ঐতিহ্য ছিল। সেটি কারা নষ্ট করলেন?
জেড আই খান পান্না : প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে আইনজীবীদের শক্ত ও অগ্রণী ভূমিকা ছিল। দল যাঁরা করতেন, তাঁরাও আইনজীবী সমিতির কাজে এসে ঐকমত্য দেখাতেন। তাঁরা শুধু নিজেদের স্বার্থ দেখতেন না। সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ একমাত্র জায়গা ছিল, যেখানে মানুষ আশার আলো দেখত, যেখানে গণতান্ত্রিক সহনশীলতা ছিল। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনেও সব সময় স্বচ্ছতা ছিল। এবার সেটাকে একেবারে মাটি চাপা দিয়ে দেওয়া হলো। কবর দিয়ে দেওয়া হলো। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা যদি গণতন্ত্রের চর্চা না করেন, এখানে যদি নির্বাচন নিয়ে মারামারি হয়, তাহলে মানুষ তাঁদের বিশ্বাস করবে কীভাবে?
- সামরিক শাসকেরাও তো আইনজীবীদের নিয়ে দলবাজি করতে চেষ্টা করেছেন।
জেড আই খান পান্না : হ্যাঁ, চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাঁরা সফল হননি। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে সংবিধান স্থগিত করার বিরুদ্ধে আইনজীবীরা প্রতিবাদ করেছিলেন। বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাবা সিরাজুল হক সে সময় সমিতির সভাপতি ছিলেন। তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় আইনজীবীরা সর্বসম্মত নিয়ে বলেছিলেন, সংবিধান স্থগিত করার এখতিয়ার কারও নেই। আন্দোলন করতে গিয়ে ১৭ জন আইনজীবী জেলেও গিয়েছিলেন।
- এরশাদ আমলে আপনারা তো হাইকোর্ট বেঞ্চের বিকেন্দ্রীকরণের বিরুদ্ধেও আন্দোলন করেছিলেন।
জেড আই খান পান্না : সেটা অনেক পরে হয়েছে। কিন্তু সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আইনজীবীদের আন্দোলন শুরু হয় বিরাশিতেই। ছাত্রদের মাঠে নামারও আগে।
- সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে পুলিশের হামলা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটল। সাংবাদিক ও আইনজীবীরা নিগৃহীত হলেন। এটা কি এড়ানো যেত না?
জেড আই খান পান্না : নির্বাচন নিয়ে আইনজীবীদের মধ্যে সমস্যা হতে পারে। আলোচনা করেই তার সমাধান করতে হবে। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালত অঙ্গনে তো পুলিশ ঢুকতে পারে না। সামরিক শাসনামলেও ঘটেনি। পুলিশ গেটের বাইরে থাকত। এমনকি সাদা পোশাকে গোয়েন্দা পুলিশ ভেতরে এলেও আড়ালে আবডালে থাকত। পুলিশের কাজ হলো কোথাও আইনশৃঙ্খলার অবনতি হলে সেটা ঠেকানো। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে তো তারা মারামারি থামাতে আসেনি। তারা আইনজীবী ও সাংবাদিকদের ওপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। প্রায় দেড় শ আইনজীবী আহত হয়েছেন। অনেককে কলার ধরে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে গেছে। একজন নবীন আইনজীবী হেঁটে যাচ্ছিলেন, পুলিশ তাঁকে ধরে চড় মারছে। সাংবাদিকদের জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলেছে। এটা কি আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নমুনা!
- নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব থেকে মশরুরুল হক চৌধুরী পদত্যাগের পরই তো দুই পক্ষের গোলযোগ শুরু হলো। তিনি পদত্যাগ করলেন কেন?
জেড আই খান পান্না : আমি তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে জানি। তিনি রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের সমর্থক। কিন্তু তাঁর সততা ও নিষ্ঠা প্রশ্নাতীত। তাঁকে দিয়ে কেউ অন্যায় কিছু করাতে পারবেন না। যাঁরা অন্যায় করাতে পারেননি, তাঁরাই তাঁকে পদত্যাগে বাধ্য করেছেন। মজার বিষয় হলো তাঁকে পদত্যাগে বাধ্য করার অভিযোগটি বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের বিরুদ্ধে আসেনি; এসেছে আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীদের বিরুদ্ধেই।
- সেদিনের অঘটনের জন্য কি আপনি দুই পক্ষের আইনজীবীদের দায়ী করবেন?
জেড আই খান পান্না : দুই পক্ষেরই অসহিষ্ণুতা ছিল। দুই পক্ষই এখানে গায়ের জোর খাটিয়েছে। আলোচনা করে সমাধানের চেষ্টা করেনি।
- আপনি বলেছেন, সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে এর আগে কখনো পুলিশ আসেনি। তারা গেটের বাইরে থেকেছে। কিন্তু এবারে কারা পুলিশ ডাকল?
জেড আই খান পান্না : কে পুলিশ ডেকেছে জানি না। তবে এটুকু জানি, প্রধান বিচারপতির দপ্তরের অনুমোদন ছাড়া সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে পুলিশ আসতে পারে না। আমি মনে করি, পুলিশের আদালত প্রাঙ্গণে এসে অ্যাকশনে যাওয়া অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ঘটনা। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনকে যেখানে নিয়ে যাওয়া হলো, তা জাতীয় রাজনীতিকে আরও অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যাবে।
- অঘটন ও এক পক্ষের ভোট বর্জনের পরও তো সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ভোট হতে দেখলাম।
জেড আই খান পান্না : এভাবে তো নির্বাচন হয় না। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবশেষটুকুও মুছে গেল।
- আপনি নিজে কি ভোট দিয়েছেন?
জেড আই খান পান্না : না, আমি ভোট দিইনি। একতরফা ভোটের ফল যখন আমি জানি, কেন ভোট দিতে যাব? জিয়া ও এরশাদের ‘হ্যাঁ না’ ভোটের চেয়েও খারাপ ভোট হয়েছে।
- ভোটের বিজয়ীদের নামও ঘোষণা করা হয়েছে। ১৪টি পদেই আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্যানেল জয়ী হয়েছে।
জেড আই খান পান্না : একতরফা ভোটের মতো ফলও একতরফা ঘোষিত হয়েছে। যত দিন পারে তারা ক্ষমতায় থাকবে। তাই বলে সাধারণ আইনজীবীরা সেটা মেনে নেবেন বলে মনে হয় না। বৃহস্পতিবারও কয়েকজন আইনজীবী পুলিশের নির্যাতনের প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছেন। তাদের ব্যানারে লেখা ছিল সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সদস্যবৃন্দ। তারা এক সপ্তাহের মধ্যে পুলিশি হামলার বিচার চেয়েছেন।
- আপনারা জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা সমস্যা সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেবেন কি?
জেড আই খান পান্না : উদ্যোগ নিতে তো আপত্তি নেই। কিন্তু যাঁরা সমস্যাটি তৈরি করেছেন, তাঁরা সেই উদ্যোগে সাড়া দেবেন কি না, সেটাই প্রশ্ন। কেউ যদি বলেন, সালিস মানি কিন্তু তালগাছ আমার, তাহলে তো কোনো উদ্যোগই কাজে দেবে না।
- মাননীয় প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অ্যাটর্নি জেনারেল তাকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, এটি আইনজীবীদের বিষয়। তাঁর কিছু করার নেই।
জেড আই খান পান্না : কথাটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন। সুপ্রিম কোর্টের কোনো মুখপাত্র বলেননি। অন্যদিকে বিএনপির নেতারা প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করে ভিন্ন কথা বলেছেন। অতীতে আদালতের হস্তক্ষেপের উদাহরণ কিন্তু আছে। ২০১২ সালের বার কাউন্সিলের নির্বাচন নিয়ে সমস্যা হলে আদালতে রিট হয়েছিল এবং সেই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি নির্বাচনের তফসিল পরিবর্তন করেছিলেন। তাই আদালতের কিছু করণীয় নেই—এ কথা ঠিক নয়।
- এই ঘটনার পেছনে কি কোনো রাজনীতি ছিল বলে মনে করেন?
জেড আই খান পান্না : রাজনীতির বাইরে কেউ নন। চুপ থাকাটাও একধরনের রাজনীতি। কিন্তু আইনজীবীরা তো সেই রাজনীতি করতে গিয়ে দলীয় লাঠিয়ালের ভূমিকা নিতে পারেন না। অতীতে আইনজীবীদের যে সংগ্রামী ভূমিকা ছিল, এখন সেটি পুনরুদ্ধার করা কঠিন হবে।
- দুই পক্ষের আইনজীবীদের প্রতি আপনার আহ্বান কী?
জেড আই খান পান্না : আমার আবেদন থাকবে, সবাইকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা করতে হবে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও পরমতসহিষ্ণুতা দেখাতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণকে দলীয় রাজনীতির বাইরে রাখতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির পুরোনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, কেবল আইনজীবী সংগঠন অতিমাত্রায় দলীয়করণ হয়নি। প্রকৌশলী, চিকিৎসক, শিক্ষক ও সাংবাদিক সংগঠনের অবস্থা আরও খারাপ
* আপনাকে ধন্যবাদ।
জেড আই খান পান্না : আপনাকেও ধন্যবাদ।