নয়াবার্তা প্রতিবেদক : ঋণ কেলেঙ্কারি, অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অনিয়মে গত ১৫ বছর ব্যাপক আলোচনায় ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। বিশেষ করে হলমার্ক কেলেঙ্কারির কারণে ২০১১ সালে প্রথম আলোচনায় আসে ব্যাংকটি। শুধু হলমার্ক নয়, টি এন্ড ব্রাদার্স, রূপসী, মডার্ন স্টিলসহ ২০ গ্রাহকের ৫ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হয়ে পড়েছে।
এক কথায় নির্দিষ্ট কয়েকটি গ্রাহকের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে রাষ্ট্রের অর্থে গঠিত ব্যাংকটি। চলতি বছর ব্যাংকটিকে এসব গ্রাহক থেকে আদায়ের লক্ষ্য দিয়েছিল আড়াই হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ৫ মাসে আদায় হয়েছে মাত্র ৪ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের বিতরণ করা মোট ঋণের ৪০ দশমিক ৫০ শতাংশই দেওয়া হয়েছে সরকারি ও বেসরকারি খাতের ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে। এরই মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে এর উল্লেখযোগ্য অংশ। চলতি বছরের ৩১ মে পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে আটকা পড়েছে ৫ হাজার ৮১ কোটি টাকা। ২০২৪ সালে এসব খেলাপি গ্রাহক থেকে ২ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অথচ বছরের পাঁচ মাসে আদায় হয়েছে মাত্র ১১৪ কোটি টাকা বা ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সোনালী ব্যাংক ৯৩ হাজার ৯৬ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এর ১২ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকাই খেলাপি হয়ে পড়েছে, যা মোট ঋণের ১৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এর বড় অংশই গেছে হাতেগোনা কয়েকজনের পকেটে। প্রভাবশালী এসব ব্যবসায়ীর কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে না পারায় সোনালী ব্যাংক ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছে।
ব্যাংকটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৩১ মে পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ খেলাপির তালিকায় আছে টি এন্ড ব্রাদার্স গ্রুপ। সোনালী ব্যাংকের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল শাখায় এই গ্রাহকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪৯০ কোটি টাকা। বর্তমানে এই গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসাবে রয়েছেন জিনাত ফাতেমা।
একই শাখায় গ্রাহক হলমার্ক গ্রুপের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪৮২ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটি ২০১০-১২ সালের মধ্যে জালিয়াতি করে রাষ্ট্রায়ত্ত এই ব্যাংক থেকে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা নিয়েছিল। এসংক্রান্ত মামলায় এখন কারাগারে আছেন প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ।
জানতে চাইলে হলমার্ক গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক শামিম আল মামুন বলেন, ‘হলমার্কের ঘটনা তো ১২-১৩ বছর হয়ে গেছে। ঋণ পরিশোধ করতে হলে চেয়ারম্যান ও এমডির কারামুক্তি প্রয়োজন। তারা মুক্ত হলে সম্পদ বিক্রি করে দায় পরিশোধের ব্যবস্থা করা যেত। কিন্তু আদালত কোনোভাবেই তাদের মুক্তি দিচ্ছেন না।’
তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে নারায়ণগঞ্জ কর্পোরেট শাখার গ্রাহক রূপসী গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ৪৬৫ কোটি টাকা। চতুর্থ অবস্থানে চট্টগ্রামের লালদিঘী করপোরেট শাখার গ্রাহক মডার্ন স্টিল মিলসের খেলাপি ৪৪৮ কোটি টাকা। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত রতনপুর গ্রুপের এই প্রতিষ্ঠান শুধু সোনালী ব্যাংক নয়, আরও কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও ঋণখেলাপি। ট্রাস্ট ব্যাংকের এসংক্রান্ত এক মামলায় রতনপুর গ্রুপের মালিক মাকসুদুর রহমান ও তার দুই ছেলে মিজানুর রহমান এবং মারজানুর রহমানকে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত।
পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে তাইপেই বাংলা ফেব্রিক্স। প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণ ৩৪৮ কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংকের লোকাল অফিস থেকে নেওয়া এই ঋণ দীর্ঘদিন ধরেই খেলাপি হয়ে আছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সারওয়ার হোসেন বলেন, ‘গ্যাস সমস্যা আর ক্রয়াদেশ না থাকায় ঋণটি খেলাপি হয়ে গেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই ঋণ পুনঃতপশিল করার চিন্তা আছে।’
ষষ্ঠ অবস্থানে ফেয়ার ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩১৫ কোটি টাকা। ২০১২ সালে খেলাপি হওয়া প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন জসিম আহমেদ। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য তাকে একাধিকবার ফোন করা হলেও রিসিভ করেননি।
এছাড়া নারায়ণগঞ্জ করপোরেট শাখার রহমান গ্রুপের ৩১৪ কোটি, লোকাল অফিসের অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের ৩০০ কোটি, একই শাখার মুন্নু ফেব্রিক্সের ২৫৫ কোটি, দিলকুশা করপোরেট শাখায় লীনা গ্রুপের ২১৫ কোটি, লালদিঘী করপোরেট শাখায় রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলস ২১৪ কোটি, লোকাল অফিসে মাগুরা পেপার মিলসের ২০৩ কোটি, একই শাখার এপেক্স উইভিং অ্যান্ড ফিনিশিং ১৫৬ কোটি, বিশ্বাস গার্মেন্টসের ১৫৫ কোটি, রেজা জুট ট্রেডিংয়ের ১৫১ কোটি, মেঘনা কনডেন্সড মিল্ক ১৩১ কোটি, সোনালী জুট মিলস ১২৭ কোটি, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড ১১৪ কোটি, সুপ্রিম জুট অ্যান্ড নিটিংয়ের ১০৪ কোটি এবং শরীফ জুট ট্রেডিংয়ের ৯৩ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে।