১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণের রেকর্ড

নয়াবার্ত‍া প্রতিবেদক : নানা ধরনের ছাড় দিয়েও খেলাপি ঋণ কমাতে সফল হয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। গত এপ্রিল-জুন সময়ে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। ফলে জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। এই খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। গত মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা।

অথচ ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন দেশে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। এখন তা দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়াল। অর্থাৎ ১৪ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৭ গুণ। এই সময়টা ছিল ঋণখেলাপিদের জন্য সুবর্ণ সময়।

বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে হিসাব দিচ্ছে, তা প্রকৃত তথ্য নয়। কারণ, প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরও অনেক বেশি। মামলার কারণে অনেক ঋণকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। আবার অবলোপন করা ঋণও খেলাপির হিসাবে নেই।
অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেসবাউল হক বলেন, খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এর একটা কারণ ৩১টি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ফলে সর্বমোট খেলাপি ঋণে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। কিছু কিছু ব্যাংক ঋণ পুনঃ তফসিল করতে পারেনি। আবার কিছু ব্যাংকের ঋণ পুনঃ তফসিল করার পর আবার খেলাপি হয়েছে।

একটি ব্যাংকে ৭০০ কোটি টাকার একটি ঋণ পুনঃ তফসিল করা হয়েছিল। কিন্তু সেটির কিস্তি দিতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে তা আবার খেলাপি হয়ে পড়ে। এ রকম কিছু বড় ঋণ পুনঃ তফসিল হওয়ার পরও আবার কিস্তি দিতে ব্যর্থতার কারণে খেলাপি হয়েছে। অন্য যেসব কারণ রয়েছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে।

আগে একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের কোনো প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হলে তাদের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ পাওয়ার সুযোগ ছিল না। এই নতুন আইনের কারণে সামনের দিনগুলোতে খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

যেভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণ : করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিগত ২০২০ ও ২০২১ সালে কোনো ঋণ পরিশোধ না করেও খেলাপিমুক্ত ছিলেন গ্রাহকেরা। ২০২২ সালে এসব নীতি ছাড় তুলে দেওয়ার পর ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ার প্রবণতা দেখা দেয় চলতি বছরের শুরু থেকেই।

এ অবস্থায় খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেড়ে যেতে পারে, এই আশঙ্কায় বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুনে ব্যাংকঋণ পরিশোধে আবার ছাড় দেয়। ওই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, আগামী জুন মাসের মধ্যে ঋণের কিস্তির অর্ধেক টাকা জমা দিলেই একজন গ্রাহককে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তের ফলে যেসব ঋণ গ্রাহক খেলাপি হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে পড়েছিলেন, তাঁরা অর্ধেক টাকা জমা দিয়েই নিয়মিত গ্রাহক হিসেবে থাকার সুযোগ পান। এই সুবিধা দেওয়া হয় শুধু মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে। ব্যাংক খাতের ১৫ লাখ কোটি টাকা ঋণের প্রায় অর্ধেকেই মেয়াদি ঋণ। এত সুবিধা দেওয়ার পরও খেলাপি কেবল বাড়ছেই; বরং বারবার ছাড় দেওয়ার কারণে ভালো গ্রাহকেরাও ঋণ পরিশোধে আগ্রহ হারাচ্ছেন বলে মনে করেন ব্যাংকাররা। তাঁদের মতে, এতে ব্যাংকগুলো তারল্যসংকটে পড়ছে এবং নতুন ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা হারাচ্ছে।

এদিকে চলতি বছরেই জাতীয় সংসদে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হয়েছে। এর ফলে খেলাপিরাও ঋণ নেওয়ার সুযোগ পাবেন। আগে একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের কোনো প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হলে তাদের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ পাওয়ার সুযোগ ছিল না। এই নতুন আইনের কারণে সামনের দিনগুলোতে খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

এই আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার শর্ত দিয়ে রেখেছে। এ শর্তও আপাতত পূরণ হচ্ছে না বলেই দেখা যাচ্ছে।

প্রকৃত খেলাপি কত : মূলত বর্তমান সরকার ২০১৫ সাল থেকে ঋণখেলাপিদের জন্য বড় বড় ছাড় দিয়ে আসছে। ফলে খেলাপিরা বারবার ঋণ পুনঃ তফসিল করে নিয়মিত দেখাচ্ছেন। এর মাধ্যমে তাঁরা নতুন করে ঋণও নিচ্ছেন এবং নতুন করে খেলাপি হচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক গত আগস্টে আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেছে, দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপির চেয়ে পুনঃ তফসিল ঋণের পরিমাণ বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে দেশে পুনঃ তফসিল করা ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। সুতরাং বাংলাদেশ ব্যাংক এখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১০ দশমিক ১১ শতাংশ দেখালেও প্রকৃত খেলাপির পরিমাণ অনেক বেশি। এর বাইরেও মামলার কারণে আটকা আছে আরও প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। ফলে সব মিলিয়ে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ হবে ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি, শতাংশ হারে যা প্রায় ৩০ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) পুনঃ তফসিল করা ঋণ ও আদালতের স্থগিতাদেশ দেওয়া ঋণকে খেলাপি হিসেবে দেখানোর পক্ষে।

এই আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার শর্ত দিয়ে রেখেছে। এ শর্তও আপাতত পূরণ হচ্ছে না বলেই দেখা যাচ্ছে।

যত ছাড়, তত বেশি খেলাপি : দেশে আওয়ামী লীগ সরকার উদার হস্তে ঋণখেলাপিদের ছাড় দেওয়া শুরু করে ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর। নতুন করে ক্ষমতায় এসে ২০১৫ সালে সরকার প্রভাবশালী ঋণখেলাপিদের জন্য ঋণ পুনঃ তফসিলের বিশেষ এক স্কিম হাতে নেয়। তখন তিনবারের বেশি ঋণ পুনঃ তফসিল করা যেত না। কিন্তু বেশির ভাগ প্রভাবশালী উদ্যোক্তাই তিনবার সুযোগটি নিয়েও খেলাপি হয়ে পড়েছিলেন। ফলে ঋণ পুনর্গঠন নামে নতুন এক সুবিধা দেওয়া হয়। ওই সুবিধার আওতায় দেশের বড় ১১টি শিল্প গ্রুপের প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছিল। তারপরও এসব গ্রুপের বেশির ভাগই ঋণের কিস্তি আর পরিশোধ করেনি।

আবার বড় ছাড় দেওয়া হয় ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর। ২০১৯ সালে অর্থমন্ত্রী হয়েই আ হ ম মুস্তফা কামাল দেশের ইতিহাসে ঋণখেলাপিদের জন্য সবচেয়ে বড় সুবিধাটি দেন। সে সময় ২ শতাংশ কিস্তি দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ রাখা হয়। নতুন নিয়মে ঋণ পরিশোধের জন্য ১০ বছর সময় দেওয়া হয়, এর মধ্যে প্রথম এক বছর কোনো কিস্তি দিতে হয়নি। সেই সুযোগ নেওয়া বেশির ভাগই পরে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।

অথচ অর্থমন্ত্রী ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসেই এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, আর এক টাকাও খেলাপি ঋণ বাড়বে না। তখন দেশে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। সেই খেলাপি বেড়ে এখন দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। কেবল পরিমাণে নয়, শতাংশ হারেও বেড়েছে খেলাপি ঋণ। আর আইএমএফের দেওয়া পদ্ধতি অনুযায়ী পুনঃ তফসিল ও মামলায় আটকে থাকা ঋণের হিসাবে নিলে পরিমাণ ও শতাংশ হারে খেলাপি ঋণ বেড়েছে বহুগুণ।

অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম এ নিয়ে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে হিসাব দিচ্ছে, তা প্রকৃত তথ্য নয়। কারণ, প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরও অনেক বেশি। মামলার কারণে অনেক ঋণকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। আবার অবলোপন করা ঋণও খেলাপির হিসাবে নেই। এ দুই ঋণকে বিবেচনায় নিলে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। যত দিন ঋণখেলাপিদের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করে আলাদাভাবে বিচারের ব্যবস্থা করা যাবে না, তত দিন খেলাপি ঋণও কমবে না।

মইনুল ইসলাম আরও বলেন, ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সালে সাবেক দুই প্রধান বিচারপতি মো. সাহাবুদ্দীন আহমদ ও মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ঋণখেলাপিদের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা বলেছিলেন। কিন্তু কোনো সরকারই এ উদ্যোগ নেয়নি। খেলাপি ঋণের লাগামহীন ঘোড়াকে থামাতে হলে ঋণখেলাপিদের সম্পদ জব্দের পাশাপাশি তাঁদের জেলের ভাত খাওয়াতে হবে। তাহলে হয়তো এ অবস্থার কিছুটা উন্নতি হতে পারে। যত দিন এ কাজ করা যাবে না, তত দিন পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে না।

Share