নয়াবার্তা প্রতিবেদক : ২০২৩ সালে প্রবাসী আয় এসেছে ২১ দশমিক ৯২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ ২ হাজার ১৯১ কোটি ৫৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা। যা তার আগের বছরের চেয়ে ৬৩ কোটি ডলার বা ২ দশমিক ৮৭ শতাংশ বেশি। এর আগে ২০২২ সালে ১২ মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ২১ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ ২ হাজার ১২৯ কোটি টাকা। গতকাল ২ জানুয়ারি মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবাসী আয়ের এ হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, বিদায়ী বছর ২০২৩-এ প্রবাসী আয়ে ওঠা-নামার মধ্য দিয়ে গেছে। প্রবাসী আয়ে নিম্নমুখী প্রবণতা বাড়ায় ডলার সংকট প্রকট হয়। এ সময় খোলা মার্কেটে ডলারের উচ্চ মূল্যের কারণে প্রবাসী আয় দেশে আসার ক্ষেত্রে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে অবৈধ হুন্ডির বাজার ছিল রমরমা। এই সময় খোলা বাজারে ডলার দাম ১২৫ টাকা ছাড়িয়ে যায়। ফলে ব্যাংকিং চ্যানেলে কমতে থাকে প্রবাসী আয়। গত সেপ্টেম্বরে স্মরণকালের সর্বনিম্নে নেমে যায় প্রবাসী আয়। এ সময় প্রবাসী আয় বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কিছু উদ্যোগ নিলে খাতটি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। এই খাতে পরের মাস অক্টোবরে বড় ধরনের উন্নতি হয়। আর তা বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে একটি ভালো সমাপ্তির মধ্য দিয়ে বিদায় নেয় ২০২৩। ডিসেম্বরে মাসে প্রবাসী আয় এসেছে ১৯৮ কোটি ৯৮ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার। আগে প্রবাসী আয়ের ডলারের যে দামে কেনা হতো, অক্টোবর মাসে তা বাড়িয়ে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা করা হয়। প্রণোদনা দেওয়া হতো ২ দশমিক ৫০ পয়সা হারে। আরও ২ দশমিক ৫০ শতাংশ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বেশি দিতে পারে-এমন অনুমতি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর বাইরেও বেশি টাকা দিতে পারে, এমন অনুমতিও দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর আগে প্রবাসী আয় বৈধপথে ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠাতে সহজ করার পাশাপাশি বেশি প্রবাসী আয় পাঠানো প্রবাসীদের সম্মাননা ঘোষণা ও বেশ কিছু বাধা-নিষেধ তুলে নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর থেকে প্রবাসী আয় বাড়তে থাকে। বিশেষ করে ডলারের তীব্র সংকটের কারণে অনেক ব্যাংক যখন এলসি খুলতে সমস্যার সম্মুখিন হলে বছরের শেষ সময়ের দিকে বেশি দামে রেমিট্যান্স কেনার সুযোগ দেওয়া হয়। এতে করে কিছু কিছু ব্যাংক নির্ধারিত দামের চেয়ে ১০ থেকে ১২ টাকা বেশি দিয়ে প্রবাসী আয় কিনেছে। যার কারণে বছরের শেষ সময় রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। তা না হলে এবারও প্রবাসী আয় কম হতো। ব্যাংকগুলো এখন ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা দামে প্রবাসী ও রপ্তানি আয়ের ডলার কিনছে। আর আমদানিকারকদের কাছে বিক্রির ক্ষেত্রে ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম হচ্ছে ১১০ টাকা। তবে কয়েকটি ব্যাংক সংকটের কারণে রেমিট্যান্সের ডলার কিনেছে ১২৩ থেকে ১২৪ টাকা দরে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে প্রবাসী আয় আসে ১৯৭ কোটি ৩১ লাখ ৫০ হাজার ডলার। পরের মাস আগস্টে এসেছিল প্রায় ১৬০ কোটি ডলার। সেপ্টেম্বরে আসে ১৩৩ কোটি ৪৩ লাখ ৫০ লাখ ডলার। অক্টোবরে আসে ১৯৭ কোটি ১৪ লাখ ৩০ হাজার ডলার। নভেম্বরে ১৯৩ কোটি ডলার এবং সর্বশেষ ডিসেম্বর মাসে আসে ১৯৮ কোটি ৯৮ লাখ ৭০ হাজার ডলার। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ১ হাজার ৪৯ কোটি ৩৪ লাখ ডলার। সে হিসাবে গত অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে ৩০ কোটি ৫২ লাখ ডলার বেশি এসেছে। তবে গত অর্থবছরের প্রথম ও দ্বিতীয় মাসে অর্থাৎ জুলাই এবং আগস্টে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছিল। অন্য মাসগুলোতে দেড় বিলিয়ন বা তার কাছাকাছি রেমিট্যান্স আসে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে এসছিল ২০৯ কোটি ৬৩ লাখ ২০ হাজার ডলার। দ্বিতীয় মাস আগস্টে এসেছিল ২০৩ কোটি ৬৯ লাখ ৩০ হাজার ডলার। পরের মাস সেপ্টেম্বরে এসেছিল ১৫৩ কোটি ৯৬ লাখ ডলার, অক্টোবরে ১৫২ কোটি ৫৫ লাখ, নভেম্বরে ১৫৯ কোটি ৫১ লাখ এবং ডিসেম্বরে এসেছিল ১৬৯ কোটি ৯৭ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, সদ্য বিদায়ী ডিসেম্বরে আসে ১৯৮ কোটি ৯৮ লাখ ৭০ হাজার ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ২১ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা। আলোচ্য মাসে দিনে গড়ে এসেছে ৬ কোটি ৪১ লাখ ডলার বা ৭০৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। ডিসেম্বরে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ১৯ কোটি ৩৭ লাখ ৭০ হাজার ডলার, বিশেষায়িত দুই ব্যাংকের মধ্যে এক ব্যাংকের (বিকেবি) মাধ্যমে এসেছে ৬ কোটি ৬২ লাখ ৩০ হাজার ডলার। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ১৭২ কোটি ৪৫ লাখ ৯০ হাজার ডলার এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ৫২ লাখ ৮০ হাজার ডলার।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে হারে দেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানি হচ্ছে সে হারে রেমিট্যান্স বাড়েনি। কারণ ডলারের দাম বেশি পাওয়া ও পাঠানোর প্রক্রিয়া সহজ হওয়ায় হুন্ডি বা অনানুষ্ঠানিকভাবে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত হচ্ছেন প্রবাসীরা। ফলে আশানুরূপ রেমিট্যান্স আসেনি। ১ কোটি ২০ লাখ প্রবাসীর পাঠানো কষ্টার্জিত অর্থ দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ করছে। প্রবাসী শ্রমিকের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ হলেও প্রবাসী আয়ে সপ্তম স্থানে। সর্বশেষ প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ১১ মাসে ১২ লাখ ১০ হাজার কর্মী বিদেশে গেছেন। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ৪০ হাজার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ২ হাজার ১৬১ কোটি ৭ লাখ মার্কিন ডলার। তার আগের ২০২১-২০২২ অর্থবছরে মোট রেমিট্যান্স এসেছিল ২ হাজার ১০৩ কোটি ১৭ লাখ মার্কিন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরের পুরো সময়ে রেমিট্যান্সের উল্লম্ফন ছিল। ওই অর্থবছরে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২ হাজার ৪৭৮ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা, যা তার আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। ওই অর্থবছরের ১২ মাসের মধ্যে সাত মাসেই ২০০ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স আসে। এর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে প্রবাসী বাংলাদেশিরা এক হাজার ৮২০ কোটি ডলার বা ১৮ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আহরণ। তারও আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স আহরণে রেকর্ড হয়। ওই সময়ে প্রবাসীরা ১ হাজার ৬৪২ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিল। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরের রেমিট্যান্স আসে ১ হাজার ৪৯৮ কোটি ডলার। যা তার আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রবাসীদের রেমিটেন্স পাঠানোর পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৭৬ কোটি ৯৪ লাখ ডলার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আসে ১ হাজার ৪৯৩ কোটি ১১ লাখ মার্কিন ডলার। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছিল ১ হাজার ৫৩১ কোটি ৬৯ লাখ মার্কিন ডলার।