নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : দীর্ঘ ৫৫ বছর পর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রেল সংযোগ পুনঃস্থাপন হলো। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যৌথভাবে এ রেল সংযোগ উদ্বোধন করেন।
রেল সংযোগ পুনঃস্থাপনের কেন্দ্র করে চিলাহাটি রেল স্টেশন ও বাজার এলাকা জনারণ্যে পরিণত হয়। স্থল বন্দর চালুর ক্ষেত্রে এ সংযোগ গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি বলে মনে করছে এ অঞ্চলের মানুষ।
রেল সংযোগ উদ্বোধন ঘিরে চিলাহাটি রেল স্টেশনকে সাজানো হয়। স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় স্থাপন করা হয় এক হাজার মানুষ ধারণ ক্ষমতার বিশাল আকারে প্যান্ডেল। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ওই রেল যোগাযোগের উদ্বোধন করেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন রেলমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, নীলফামারী-১ আসনের সংসদ সদস্য আফতাব উদ্দিন সরকার, নীলফামারী-৪ আসনের সংসদ সদস্য আহসান আদেলুর রহমান, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সেলিম রেজা, মহাব্যবস্থাপক (পশ্চিমাঞ্চল) মিহির কান্তি গুহ, জেলা প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান চৌধুরী, বিজিবি ৫৬ ব্যাটালিয়ন নীলফামারীর অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মামনুল হক, পুলিশ সুপার মোহাম্মদসহ জেলা প্রশাসন ও রেলওয়ের কর্মকর্তারা।
উল্লেখ্য, ব্রিটিশ আমল থেকে অবিভক্ত ভারতে যোগাযোগের প্রধানতম রেলপথ ছিল চিলাহাটি-হলদিবাড়ি। এ পথ দিয়ে নিয়মিত চলাচল করত দার্জিলিং থেকে খুলনা হয়ে কলকাতা পর্যন্ত একাধিক যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী ট্রেন। ওই রেল যোগাযোগকে কেন্দ্র করে চিলাহাটিতে গড়ে ওঠে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সে সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীদের আনাগোনায় মুখর চিলাহাটিতে গড়ে উঠেছিল মার্চেন্ট সমিতি। সেই মার্চেন্ট সমিতির হাত ধরে এলাকায় হয়েছিল বিভিন্ন উন্নয়ন। তারই নিদর্শন চিলাহাটি মার্চেন্ট উচ্চ বিদ্যালয়।
১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর পথটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। পাক-ভারত যুদ্ধ শেষ হয়ে আলাদা দু’টি দেশ হলে এই চিলাহাটিতে চালু করা হয় ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস চেকপোস্ট। এর ছয় বছর পর বাংলাদেশ-পাকিস্তান ভাগাভাগি হয়। স্বাধীন বাংলাদেশ হওয়ার পর ভারতে প্রবেশের জন্য চালু করা হয় চিলাহাটিতে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস চেক পোস্ট। যা চালু থাকে ২০০২ সালের আগ পর্যন্ত। কিন্তু ২০০২ সালে বন্ধ করা হয় চিলাহাটির ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস চেকপয়েন্ট। স্থবির হয়ে পড়ে নীলফামারীসহ আশপাশ জেলার ব্যবসা বাণিজ্য।
তখন থেকেই ব্যবসায়ীসহ এলাকার মানুষের দাবি ছিল পুনরায় রেলপথ চালুর। এমন দাবিতে জেলা শহরসহ বিভিন্ন উপজেলায় পালন করা হয় মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি। এরই প্রেক্ষিতে দীর্ঘ ৫৫ বছর পর পথটি পুনরায় চালুর উদ্যোগ নেয় দুই দেশের সরকার।
২০১৮ সালে ভারত অংশে তিন কিলোমিটার এবং বাংলাদেশ অংশের ৬ দশমিক ৭২ কিলোমিটার রেলপথ পুনঃস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় দুই দেশের সরকার।
নীলফামারীর চিলাহাটি থেকে ভারতের হলদিবাড়ি সীমান্ত পর্যন্ত বাংলাদেশ অংশের ৬ দশমিক ৭২ কিলোমিটার রেললাইন বসানোর কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে।
৮০ কোটি ১৭ লাখ টাকা ব্যয়ের ওই প্রকল্পে রেল লাইন স্থাপন ছাড়াও বসানো হয়েছে চার কিলোমিটার লুপ লাইন, আটটি লেভেল ক্রসিং ও নয়টি ব্রিজসহ অন্যান্য অবকাঠামো।
সব নির্মাণকাজ সমাপ্ত করে পরীক্ষামূলক ট্রেন চালানো হয়েছে বাংলাদেশ অংশে। চিলাহাটিতে একটি আধুনিক আন্তর্জাতিক রেল স্টেশনও নির্মাণ করা হচ্ছে।
ভারত হলদিবাড়ি থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত পর্যন্ত তিন কিলোমিটার রেললাইন স্থাপনসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণকাজ শেষ করে তাদের অংশে চালিয়েছেন পরীক্ষামূলক ট্রেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ঘিরে তাদের অংশেও নেওয়া হয়েছে নানা প্রস্তুতি। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে প্রবেশ দ্বারে (তাদের অংশে) রেলপথের ওপর স্থাপন করা হয়েছে স্থায়ী তোরণ। ট্রেন চলাচলের উদ্বোধন উপলক্ষে ওই তোরণকে সাজানো হয়েছে রঙিন সাজে।
চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রেল লিংক স্থাপনের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী আব্দুর রহীম বলেন, ‘১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর এ পথটি বন্ধ হয়। এরপর বর্তমান সরকার ২০১৫ সালে বন্ধ থাকা রেল লিংক পুনরায় চালুর উদ্যোগ নেয়। সে লক্ষ্যে ২০১৮ সালে চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রেল লিংকটি স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। ২০১৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন বর্তমান রেলপথমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মো. নুরুল ইসলাম সুজন এবং ভারতীয় হাইকমিশনার রিভা গাংগুলি। আমরা জোরেশোরে মেইন রেললাইনসহ আনুষঙ্গিক কাজগুলো আমরা সম্পন্ন করি। ভারতও তাদের অংশের কাজ শেষ করে। এরপর উভয় অংশে পরীক্ষামূলক ট্রেন চালানো হয়।’
এদিকে উদ্বোধন ঘোষণার পর চিলাহাটি রেলস্টেশন থেকে পণ্যবাহী একটি ট্রেন ছেড়ে যায় ভারতের হলদিবাড়ির উদ্দেশ্যে। বাংলাদেশর একটি রেল ইঞ্জিন ভারতীয় ৩২টি খালি ওয়াগন নিয়ে ভারতের হলদি বাড়ি রেলওয়ে স্টেশনে প্রবেশ করে দুপুর আড়াইটার দিকে। এসব ওয়াগান হলদিবাড়ি রেলস্টেশনে রেখে পুনরায় সীমান্ত অতিক্রম করে দেশে ফিরে আসবে বাংলাদেশ রেলওয়ের ইঞ্জিনটি।
চিলাহাটি থেকে ভারতের হলদিবাড়ির উদ্দেশে মালবাহী ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার সময় চিলাহাটি স্টেশনের দুই প্রান্তে ছিল উৎসুক জনতার দীর্ঘ ভিড়।
এ সময় কথা হয় সাইদুল ইসলাম (৬৫) নামের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বাবা-দাদার কাছে গল্প শুনেছি। এই পথ দিয়ে আগে ট্রেন যেত ভারতে। আজ প্রায় ৫৫ বছর পর আমি তা নিজে দেখতে পেলাম।’
চিলাহাটি বাহারের এলাকার আশিকুর রহমান (৫৫) বলেন,‘আমাদের দীর্ঘ দিনের দাবি ছিল চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রেলপথ ও চিলাহাটি স্থলবন্দর চালু করণের। সেই দাবির প্রেক্ষিতে আজ রেলপথে মালবাহী ট্রেন চলাচলের উদ্বোধন করা হয়েছে। এ জন্য আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানায়।
সাংবাদিক ও ব্যবসায়ী আশরাফুল হক কাজল (৫৮) বলেন, চিলাহাটি স্থল বন্দর চালুর ক্ষেত্রে এই রেলপথ সংযোগটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আজ মালবাহী ট্রেন চলাচলের মধ্য দিয়ে এর যাত্রা হয়েছে আমরা চাই আগামী ২৬ মার্চের মধ্যে এই পথ দিয়ে যেন যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করতে পারে। সেই সঙ্গে গেজেট হয়ে থাকা চিলাহাটি স্থলবন্দরটি যেন চালু করার জন্য দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তবে দ্রুত যাত্রী পারাপারে ইমিগ্রেশনসহ পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর বাস্তবায়নের দাবি ব্যবসায়ীদের।
এ বিষয়ে নীলফামারী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক সভাপতি ও বর্তমান জেলা ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুল ওয়াহেদ সরকার বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা ছিল পূর্ণাঙ্গ একটি স্থলবন্দর। বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেটি স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তারই আলোকে রেলসংযোগ স্থাপনের কাজটি সম্পন্ন করেছেন তিনি। চিলাহাটি-হলদিবাড়ি যে রেল লিংকটির সূচনা ঘটছে এর মধ্যে উত্তরবঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্যের যুগান্তকারী একটি পরিবর্তন ঘটবে বলে আমরা মনে করি। মোংলা বন্দরে কার্যকারিতা বৃদ্ধি পাবে। বিশেষ করে নেপাল, ভুটান এবং সেভেন কান্ট্রিখ্যাত দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের ভালো একটি লিংক স্থাপিত হবে। তবে আমাদের ব্যবসায়ীদের দাবি চিলাহাটিকে পূর্ণাঙ্গ একটি স্থলবন্দরে রূপান্তরের। রেল সংযোগ স্থাপনে সেটি অনেকটাই পূর্ণতার পেল। আমরা দ্রুত ইমিগ্রেশন স্থাপন করে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচলের এবং পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর রূপদানের দাবি জানাচ্ছি।’
রেলপথমন্ত্রী মো. নুরল ইসলাম সুজন জানান, এ পথে দিয়ে আপাতত দুই দেশের মধ্যে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল করবে। এ ছাড়া উভয় দেশের সম্মতিক্রমে আগামী ২৬ মার্চ থেকে এই পথটি দিয়ে ঢাকা থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচলের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ভারতে সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। আমাদের বিশ্বাস উভয় দেশের সবকিছু ঠিক থাকলে ২৬ মার্চই যাত্রীবাহী ট্রেনের উদ্বোধন করতে পারব আমরা।
এদিকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রেলপথটি ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এই পথ দিয়ে বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে পারব। বাণিজ্য সম্প্রসারণ হলে এই অঞ্চলের মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটবে।