‘জনস্বার্থ’ মানে কি আসলেই জনগণের স্বার্থ?

ডয়চে ভেলে : ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর সচিবেরা মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়াতি করে চাকরি করেছেন, অনেক কর্মকর্তা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। অনেক কর্মকর্তা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন, এক ডিসি মধ্যরাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে সাংবাদিক নির্যাতন করেছেন। অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে। কিন্তু ছোটখাট দুই-তিন জন কর্মকর্তা ছাড়া কারো বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। বরং এক রকম সুরক্ষা দেয়া হয়েছে।

এর একটা কারণ হলো, অতীতের যে-কোনো সময়ের চেয়ে আমলারা অনেক বেশি ক্ষমতাশালী ও ঐক্যবদ্ধ। কোনো একজন কর্মকর্তা বিপদে পড়লে সবাই মিলে তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করে। তবে এর আরেকটি দিক হলো, সরকার তাদের কাঁধে বন্দুক রেখে গুলি চালাতে হয় বলে আমলা, বিশেষ করে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের অনেক কিছু এড়িয়ে যায়।

কিন্তু এসব কিছুকে ভুল প্রমাণিত করল তথ্যসচিবের বাধ্যতামূলক অবসর। মানে হলো, আমলারা নিজেদের যতই ক্ষমতাধর মনে করুন না কেন, সরকার চাইলেই যে কারো ওপর খড়গ নেমে আসতে পারে।

আর সে কারণেই ২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইন সরকারের দরকার। আমলা নির্ভর হলেও প্রয়োজনে এই আইনের ব্যবহার ও অপব্যবহার সরকারের কাছে জরুরি। কেননা, কোনো কর্মকর্তা যদি সরকারের পুরোপুরি আনুগত্য করতে ব্যর্থ হয় বা তার মন্ত্রীর কথামতো কাজ না করে অথবা কোনো বিষয়ে বাড়াবাড়ি করে তাহলে তাকে শায়েস্তা করার বড় অস্ত্র হলো এই আইন।

গত রোববার এই আইনের ৪৫ ধারা অনুযায়ী ‘জনস্বার্থে’ মকবুল হোসেনকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়। ওই ধারায় বলা আছে, কোনো সরকারি কর্মচারীর চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর যে-কোনো সময় সরকার জনস্বার্থে প্রয়োজন মনে করলে কারণ দর্শানো ছাড়াই তাকে চাকরি থেকে অবসর দিতে পারবে। যে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ, সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার ডয়েচে ভেলেকে বলেন, সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন সাপেক্ষে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে যে-কোনো কারণেই হোক তাকে সরকার আর চাইছেন না। তাই জনস্বার্থের অজুহাতে তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে।

‘‘১/১১-র সেনা সমর্থিত সরকার ছাড়া সকল সরকার, জাতীয় পার্টি, আওয়ামী লীগ, বিএনপি সবাই আইনের এই ক্ষমতা অ্যাপ্লাই করেছে। সংবিধানে কাউকে শাস্তি দেয়ার আগে তাকে আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ দেয়ার অধিকার দেয়া আছে। সেটা এখানে মানা হচ্ছে না,” বলছিলেন তিনি।

তার মতে, এভাবে সরকার যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে তারা অনেকেই উচ্চ আদালতে গেছেন এবং আদালতে সরকারের অর্ডার বা সিদ্ধান্ত টেকেনি। তাছাড়া আদালতের রায় পেতে এত সময় লেগেছে যে এর মধ্যে ঐ কর্মকর্তা চাকরি শেষ করে অবসরে চলে গেছেন। ফলে আইনটি যৌক্তিকতা হারিয়েছে।

সাবেক এই মন্ত্রীপরিষদ সচিব মনে করেন, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া এই আইন অকার্যকর বা বাতিল করা সম্ভব হবে না।

সরকার তার প্রতিটি কাজ জনস্বার্থে বা জনগণের স্বার্থে করে। এটা হচ্ছে আইনি কথা। কিন্তু সরকার এই জনস্বার্থ শব্দটা ব্যবহার করে যখন সে তার কোনো সিদ্ধান্তের বিপরীতে কারণটা বলতে চায় না বা কারণ উল্লেখ করা সরকারের জন্য অস্বস্তিকর হয়।

কারো বিরুদ্ধে যদি কোনো অভিযোগ থাকে, সেটা দুর্নীতি বা অনিয়মের অভিযোগ হোক না কেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। তবে তার একটা পদ্ধতি আছে। প্রথমে ঐ ব্যক্তিকে শোকজ করে তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। জবাব পাওয়ার পর তদন্ত কমিটির মাধ্যমে তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাকে লঘু বা গুরু দণ্ডে দণ্ডিত করা যেতে পারে। চাকরি থেকেও অপসারণ করা যেতে পারে। কিন্তু তথ্যসচিবের বেলায় কিছুই করা হয়নি।

সচিবালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, দুর্নীতির কোনো বিষয় থাকলে তথ্যসচিবকে আইনের মাধ্যমে ধরা সহজ হত। এক্ষেত্রে জনস্বার্থে কাউকে সরাসরি চাকরি থেকে সরিয়ে দেয়ার দরকার পড়ে না। তাই নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, সরকার হয়তো তার এমন কিছু পেয়েছে যার কারণে কালক্ষেপণ না করে দ্রুত তাকে সরিয়ে দিয়েছে।

‘‘সচিব হলো সরকারের কাছের এবং আত্মবিশ্বাসের কর্মকর্তা। সরকারের অনেক সিদ্ধান্তের সাথে সচিবরা জড়িত থাকেন। তাই কাউকে নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ হলে সরকার তাকে রাখতে চায় না,” এভাবেই বলছিলেন একজন যুগ্মসচিব।

কয়েকজন বলেন, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা অনেক সংগঠিত। কোথায় কী হচ্ছে তার খবর তারা সবসময় রাখে। কোথায় কার পোস্টিং বা পদোন্নতি হয় দ্রুত খবর পেয়ে যায়। সব জায়গায় তাদের লোক আছে। কে ডিসি হবে, কবে পোস্টিং হবে, কে ওএসডি হতে পারে, সব কিছু নখদর্পনে রাখে। অথচ তথ্যসচিবের ব্যাপারটা জানার আগেই ঘটে যায়।

অনেকে এই ঘটনা ভিন্নভাবে দেখছেন। মনে করছেন, এটা আমলাদের প্রতি সরকারের একটা কঠোর বার্তা। আমলাদের সবকিছু যে সরকার মনিটর করছে এই ঘটনার মধ্য দিয়ে সেটা দেখানো হলো।

আর সে কারণেই প্রশাসনের কর্মকর্তারা যতই শক্তিশালী হোক না কেন তথ্যসচিবের চাকরিচ্যুতির ব্যাপারে কেউ কোনো টু শব্দ করছে না। ‘‘এটা অনেক বড় বার্তা দিল সরকার। এর মধ্য দিয়ে সরকার জানিয়ে দিল যে কেউ সরকারের ঊর্ধ্বে না,” নাম প্রকাশ না করে এক কর্মকর্তা ডয়েচে ভেলেকে বলেন।

এর আগে গত ১৪ জুন ফেসবুকে ছদ্মনামে সরকার প্রধানকে ইঙ্গিত করে ‘কুরুচিপূর্ণ ভাষায়’ কবিতা লিখে চাকরিচ্যুত হন জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব।

তবে মধ্যরাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় আলোচিত কুড়িগ্রামের সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীনকে কোনো শাস্তি প্রদান করা যায়নি। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তার বেতন বৃদ্ধি দুই বছরের জন্য স্থগিত রাখার লঘুদণ্ড দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

তবে ঐ ডিসি লঘুদণ্ডাদেশ মওকুফের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আপিল করলে রাষ্ট্রপতি বেতন বৃদ্ধি স্থগিত রাখা দণ্ডাদেশ থেকে রেহাই দেন। পরবর্তীতে তাকে পদোন্নতি দিয়ে যুগ্মসচিব করা হয়।

এমন আরও অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ থাকলেও কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

Share