রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র কার নিয়ন্ত্রণে

আল-জাজিরা : প্রতিবেশী মিত্রদেশ বেলারুশে কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি গত শনিবার এ ঘোষণা দিয়ে বলেন, এ ব্যাপারে বেলারুশের সঙ্গে রাশিয়ার একটি সমঝোতা হয়েছে। রাশিয়ার এ পদক্ষেপে পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধ চুক্তি লঙ্ঘিত হবে না। কারণ, রাশিয়া তার পারমাণবিক অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ বেলারুশের হাতে দেবে না।

পুতিনের এমন ঘোষণার প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রের ভান্ডার কত বড়, কে এ অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ করে—বিষয়টি সামনে এসেছে। আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে এ-সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পারমাণবিক অস্ত্র পায় রাশিয়া। এখন দেশটির কাছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্টসের তথ্যমতে, ২০২২ সাল নাগাদ রাশিয়ার কাছে থাকা পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা ৫ হাজার ৯৭৭। যুক্তরাষ্ট্রের ৫ হাজার ৪২৮টি।

রাশিয়ার কাছে থাকা পারমাণবিক অস্ত্রের মধ্যে ১ হাজার ৫৮৮টি বর্তমানে মোতায়েন রয়েছে। মজুত আছে ২ হাজার ৮৮৯টি। মেয়াদ ফুরিয়েছে ১ হাজার ৫০০টির। তবে এগুলো এখনো অক্ষত অবস্থায় রয়েছে।

বুলেটিন অব দ্য অ্যাটোমিক সায়েন্টিস্টস বলছে, রাশিয়ার ৮১২টি পারমাণবিক অস্ত্র স্থলভিত্তিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রে, ৫৭৬টি সাবমেরিন থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং প্রায় ২০০টি ভারী বোমারু বিমানঘাঁটিতে মোতায়েন রয়েছে।

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ১ হাজার ৬৪৪টি কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র বর্তমানে মোতায়েন অবস্থায় রয়েছে।

ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্টসের তথ্য অনুসারে, বর্তমানে চীনের কাছে মোট ৩৫০টি, ফ্রান্সের ২৯০টি ও যুক্তরাজ্যের কাছে ২২৫টি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে।

পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে, বিশ্বের মোট পারমাণবিক অস্ত্রের ৯০ শতাংশই রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের হাতে রয়েছে।

স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের পারমাণবিক অস্ত্রের ভান্ডার সর্বোচ্চ ৪০ হাজারে পৌঁছেছিল। তখন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ছিল সর্বোচ্চ প্রায় ৩০ হাজার পারমাণবিক অস্ত্র।

রাশিয়ার কাছে প্রায় ৪০০টি পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে বলে মনে করা হয়। এ ছাড়া দেশটি ১০টি পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জিত সাবমেরিন পরিচালনা করছে। রাশিয়ার ৬০ থেকে ৭০টি পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম বোমারু বিমান রয়েছে।

২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়, রাশিয়া ও চীন নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্র সম্প্রসারণের পাশাপাশি এর আধুনিকায়নে কাজ করছে।

অন্যদিকে পুতিন দাবি করেন, তাঁর কাছে তথ্য রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র নতুন ধরনের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কয়েকটি দেশ পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালায়। অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ সংস্থার তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্র ১৯৯২ সালে, চীন ও ফ্রান্স ১৯৯৬, ভারত ও পাকিস্তান ১৯৯৮, উত্তর কোরিয়া ২০১৭ সালে পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা চালায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন সবশেষ পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছিল ১৯৯০ সালে।

রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের বিধি অনুযায়ী, দেশটির এই অস্ত্র ব্যবহারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের একমাত্র অধিকারী হলেন রুশ প্রেসিডেন্ট। কৌশলগত ও অ-কৌশলগত উভয় ধরনের পারমাণবিক অস্ত্রের ক্ষেত্রেই এ কথা প্রযোজ্য।

রাশিয়ার কথিত ‘পারমাণবিক ব্রিফকেস’ সব সময় দেশটির প্রেসিডেন্টের সঙ্গে থাকে। এ ছাড়া রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও চিফ অব জেনারেল স্টাফের কাছেও এ-জাতীয় ‘ব্রিফকেস’ থাকে বলে মনে করা হয়।

এই ব্রিফকেসকে শেগেটও বলা হয়, যা মাউন্ট শেগেটের নামানুসারে রাখা হয়েছে। মূলত এই ‘ব্রিফকেস’ হলো যোগাযোগের একটি উপায়, যা রুশ প্রেসিডেন্টকে তাঁর শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে সংযুক্ত করে। সেখান থেকে বার্তা যায় রুশ রকেট বাহিনীর কাছে। এটি অত্যন্ত গোপনীয় একটি ইলেকট্রনিক ‘কমান্ড-অ্যান্ড-কন্ট্রোল’ নেটওয়ার্ক।

২০১৯ সালে রাশিয়ার একটি টিভি চ্যানেলে একটি ফুটেজে একটি ‘ব্রিফকেস’ দেখানো হয়। সেই ব্রিফকেসে একাধিক বোতাম ছিল।

‘কমান্ড’ নামের একটি বিভাগে দুটি বোতাম দেখা যায়। একটি সাদা, অন্যটি লাল। সাদা বোতাম চাপার অর্থ ‘হামলা’। আর লাল বোতাম চাপার অর্থ হামলা ‘বাতিল’। একটি বিশেষ ফ্ল্যাশ কার্ড দিয়ে ‘ব্রিফকেসটি’ সক্রিয় করা হয়।

যদি রাশিয়া মনে করে, তারা একটি কৌশলগত পারমাণবিক হামলার সম্মুখীন, তাহলে দেশটির প্রেসিডেন্ট তাঁর সঙ্গে থাকা ব্রিফকেসের মাধ্যমে জেনারেল স্টাফ কমান্ড ও রিজার্ভ কমান্ড ইউনিটকে সরাসরি হামলার নির্দেশ পাঠাবেন। প্রেসিডেন্টের নির্দেশ পেয়ে রাশিয়ার কৌশলগত রকেট ফোর্স ইউনিট হামলা চালাবে।

পরমাণু হামলার বিষয়ে নিশ্চিত হলে পুতিন তথাকথিত তাঁর শেষ অবলম্বন ‘ডেড হ্যান্ড’ বা ‘পেরিমিটার’ব্যবস্থাকে সক্রিয় করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে রুশ কম্পিউটার পৃথিবী ধ্বংসের সিদ্ধান্ত নেবে। আর নিয়ন্ত্রিত রকেট পরমাণু হামলার নির্দেশ দেবে। আর তাতে রাশিয়াজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিশাল পরমাণু ভান্ডার থেকে শুরু হয়ে যাবে ভয়াবহতম সেই হামলা।

Share