৫০ বছরে ১৫২৮ আইন, সংবিধান সংশোধন ১৭ বার

নয়াবার্তা প্রতিবেদক : ১৯৭৩ সালের এপ্রিল থেকে চলতি ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি, এই প্রায় ৫০ বছরে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে ১ হাজার ৫২৮টি বিল বা আইন পাশ হয়েছে। আর এই সময়ে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে ১৭ বার, এর মধ্যে চারটি সংশোধনী ইতিমধ্যে সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনার সরকারের সময় মিলিয়ে আওয়ামী লীগের শাসনামলে এ যাবত ৯২৩টি আইন পাশ হয়েছে। আর জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ে সংসদে পাশ হয় ৪২৪টি আইন। এরশাদের সময় পাশ হয়েছে ১৮১টি বিল।

পাশ হওয়া বিলগুলোর মধ্যে বিএনপির শাসনামলে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত ষষ্ঠ সংসদে মাত্র একটি বিল পাশ হয়। সেটি হলো সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের আইন। আর এই পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি আইন পাশ হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নবম সংসদে, যার সংখ্যা ২৭১। এছাড়া দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক আইনও পাশ হয় আওয়ামী লীগের আমলে, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে সপ্তম সংসদে ১৯১টি আইন পাশ হয়েছিল। এছাড়া দশম সংসদেও ১৯১টি বিল পাশ হয়।

সংসদে আইন পাশের প্রক্রিয়া এবং এর ওপর যথেষ্ট আলোচনার ঘাটতি নিয়ে নাগরিক সমাজের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে বলতে গেলে সেই শুরু থেকেই। বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহ্ দীন মালিক বলেন, পাশ হওয়া এসব আইনের মধ্যে ভালো আইন যেমন আছে তেমনি খারাপ আইনও রয়েছে। তবে এখানে সমালোচনার জায়গাটা হলো যে আইনগুলো নিয়ে অতীতেও যেমন সংসদে তেমন একটা আলোচনা হয়নি, এখনও আইন নিয়ে সংসদে তেমন আলোচনা হয় না বললেই চলে। এটা নিঃসন্দেহে সংসদের ব্যর্থতা না বললেও দুর্বলতা বলতেই হবে।

অবশ্য বর্তমান সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর মতে, আইন প্রণয়ন জাতীয় সংসদের একটা বড় কাজ। সেই আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও আমরা দেখেছি, সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া শেষে বিলটি পাশের জন্য যখন সংসদে আসে তখনও বিরোধী দল থেকে অনেক সংশোধনী আনা হয়, সেটার ওপর আলোচনাও হয়। অনেক ক্ষেত্রে মাননীয় মন্ত্রীরা সেসব সংশোধনী গ্রহণও করেছেন।

এদিকে, সংবিধানের ১৭টি সংশোধনীর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময়ে ৪, জিয়াউর রহমানের সময় ২, এরশাদের সময় ৪, শেখ হাসিনার সরকারের সময় ৩ ও খালেদা জিয়ার সরকারের সময়ে ৪ বার সংবিধান সংশোধন করা হয়।

১৯৭৩ সালের ১৫ জুলাই সংসদে সংবিধানের প্রথম সংশোধনী পাশ হয়। যেটা ছিল যুদ্ধাপরাধীসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করা। ’৭৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সংসদে গৃহীত সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী ছিল অভ্যন্তরীণ গোলযোগ বা বহিরাক্রমণে দেশের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক জীবন বাধাগ্রস্ত হলে ‘জরুরি অবস্থা’ ঘোষণার বিধান সম্পর্কিত। তৃতীয় সংশোধনী আসে ’৭৪ সালের ৩ নভেম্বর; বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত চুক্তি অনুমোদন এবং চুক্তি অনুযায়ী ছিটমহল ও অপদখলীয় জমি বিনিময়ের লক্ষ্যে বিধান তৈরির লক্ষ্যে এটা করা হয়। ’৭৫ এর ২৫ জানুয়ারি আসে চতুর্থ সংশোধনী; সংসদীয় শাসন পদ্ধতির পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন পদ্ধতি চালু এবং বাকশাল গঠনের লক্ষ্যে এটা করা হয়েছিল।

’৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে ১৯৭৯ সালের ৫ এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক সরকারের যাবতীয় কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দান এবং সংবিধানে ‘বিসিমল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংযুক্তির লক্ষ্যে ’৭৯ সালের ৬ এপ্রিল সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী আনা হয়। ষষ্ঠ সংশোধনী পাশ হয় ’৮১ সালের ৮ জুলাই; উপ-রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থেকে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন করতে পারার বিধান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এই সংশোধনী আনা হয়। ’৮৬ সালের ১০ নভেম্বর আনা সপ্তম সংশোধনীর লক্ষ্য ছিল—’৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ’৮৬ সালের ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সামরিক আইন বলবত থাকাকালে প্রণীত সকল ফরমান, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের অদেশ, নির্দেশ ও অধ্যাদেশসহ অন্যান্য সকল আইন অনুমোদন। রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে ইসলামকে স্বীকৃতি দান ও ঢাকার বাইরে ছয়টি জেলায় হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন; DACCA এর নাম DHAKA এবং BANGALI এর নাম BANGLA-তে পরিবর্তনের লক্ষ্যে ’৮৮ সালের ৭ জুন অষ্টম সংশোধনী আনা হয়। রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের সঙ্গে একই সময়ে উপরাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা, রাষ্ট্রপতি পদে কোনো ব্যক্তিকে পরপর দুই মেয়াদে সীমাবদ্ধ রাখতে ’৮৯ সালের ১০ জুলাই সংসদে নবম সংশোধনী গৃহীত হয়।

রাষ্ট্রপতির কার্যকালের মেয়াদ শেষ হবার আগে ১৮০ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ব্যাপারে সংবিধানের ১২৩(২) অনুচ্ছেদের বাংলা ভাষ্য সংশোধন ও সংসদে মহিলাদের ৩০টি আসন আরও ১০ বছরের জন্য সংরক্ষিত রাখার লক্ষ্যে ’৯০ সালের ১২ জুন আনা হয় সংবিধানের দশম সংশোধনী। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের স্বপদে ফিরে যাওয়ার বিধানকল্পে ’৯১ সালের ৬ আগস্ট একাদশ সংশোধনী আনা হয়। সংসদীয় পদ্ধতির সরকার পুনঃপ্রবর্তন ও উপরাষ্ট্রপতির পদ বিলুপ্তির জন্য ’৯১ সালের ৬ আগস্ট সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী পাশ হয়। ত্রয়োদশ সংশোধনী আনা হয়েছিল ’৯৬ সালের ২৭ মার্চ; অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য এই সংশোধনী আনা হয়েছিল। নারীদের জন্য সংসদে ৪৫টি সংসদীয় আসন সংরক্ষণ, অর্থবিল, সংসদ সদস্যদের শপথ, সাংবিধানিক বিভিন্ন পদের বয়স বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০০৪ সালের ১৬ মে চতুর্দশ সংশোধনী আনা হয়।

সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আসে ২০১১ সালের ৩০ জুন, যেটির মাধ্যমে বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটে। এছাড়া সংবিধানের প্রস্তাবনা সংশোধন, ১৯৭২-এর মূলনীতি পুনর্বহাল, নারীদের জন্য সংসদে ৫০টি আসন সংরক্ষণের বিষয়ও ছিল এই পঞ্চদশ সংশোধনীতে। ১৬তম সংশোধনীটি আসে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর; যেটার মাধ্যমে বাহাত্তরের সংবিধান অনুযায়ী ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

সংবিধানের সর্বশেষ, অর্থাৎ সপ্তদশ সংশোধনী হয় ২০১৮ সালের ৮ জুলাই। আরও ২৫ বছরের জন্য জাতীয় সংসদের ৫০টি আসন শুধুমাত্র নারীদের জন্য সংরক্ষিত রেখে সংবিধানের সপ্তদশ সংশোধনী পাশ করে সংসদ।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের সংবিধান স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশ গণপরিষদে (বর্তমানে জাতীয় সংসদ) এই সংবিধান গৃহীত হয় এবং একই বছরের ১৬ই ডিসেম্বর বা বাংলাদেশের বিজয় দিবসের প্রথমবার্ষিকী হতে এটি কার্যকর হয়। সংবিধানের ১৭টি সংশোধনীর মধ্যে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পঞ্চম সংশোধনী, এইচ এম এরশাদের সপ্তম সংশোধনী, ত্রয়োদশ সংশোধনী এবং ষোড়শ সংশোধনী সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করেছে।

Share