শুল্ক গোয়েন্দার ১৩২ প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচার তদন্ত প্রতিবেদন গায়েব

নয়াবার্তা প্রতিবেদক : কয়েক বছর ধরে বিদেশে অর্থ পাচার বেড়েই চলেছে। অর্থ পাচার প্রতিরোধে টাস্কফোর্স কমিটি কাজ করে থাকে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ সংক্রান্ত তৈরি করা টাস্কফোর্স কমিটির প্রতিবেদন শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর থেকে গায়েব হয়ে গেছে। এতে রপ্তানিমুখী ১৩২ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের বিষয়ে এ-সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য ছিল। একই সঙ্গে এসব কোম্পানির পরিচালকদের অর্থ পাচারে সহায়তা করা ব্যাংক ও শুল্ক কর্মকর্তাদের যোগসাজশের বিষয়টি উঠে এসেছে। অনেক প্রভাবশালীরও নাম ছিল এই অর্থ পাচার সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে। এনবিআর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এনবিআর সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে ট্রেড বেইজড মানি লন্ডারিং বেশ আলোচিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে একাধিক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, আমদানি-রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচার হচ্ছে বেশি। এসব অর্থ পাচার ঠেকাতে নতুন করে সক্রিয় হয়েছে এনবিআর। এসব অর্থ পাচারের তথ্য অনুসন্ধানের স্বার্থে টাস্কফোর্স কমিটির প্রতিবেদন শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কাছে চেয়েছে। এনবিআর তিন দিনের মধ্যে অর্থ পাচার নিয়ে গঠিত ২১ সদস্যের টাস্কফোর্স কমিটির প্রতিবেদন চেয়েছে। এতে রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে প্রভাবশালীদের তথ্য ছিল এই প্রতিবেদনে। টাস্কফোর্স কমিটির এই প্রতিবেদন শুল্ক গোয়েন্দার কাছে নেই বলে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। সংস্থাটির মহাপরিচালক ফখরুল আলম স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এনবিআরকে জানানো হয়েছে, ১৩২ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের অর্থ পাচার নিয়ে তৈরি করা টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন শুল্ক গোয়েন্দার কাছে নেই। সংস্থাটির সব নথিপত্র যাচাই-বাছাই করে এ-সংক্রান্ত কোনো প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। এর আগে ২০১৬ সালের ৭ জুলাই তৎকালীন এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে রপ্তানিমুখী ১৩২ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের অর্থ পাচার সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। এই প্রতিবেদনে রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান মালিক ছাড়া অসাধু ব্যাংক কর্মকর্তা এবং কাস্টমস কর্মকর্তার সহযোগিতায় কীভাবে অর্থ পাচার হয়েছে, সে বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে এনবিআর সূত্র।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রথম প্রশ্ন হলো—অর্থ পাচার সংক্রান্ত টাস্কফোর্স কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কেন কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হলো না। আর রাষ্ট্রের এত গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিবেদন কেন হারিয়ে যাবে। এর পেছনে কোনো ধরনের উদ্দেশ্য রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে। এ ছাড়া প্রভাবশালী মহলের চাপে এই প্রতিবেদন গায়েব হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, যারা এই প্রতিবেদন গায়েব করেছে বা হারিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ, যারা অর্থ পাচার করেছেন তারা যেমন অভিযুক্ত আর যারা এই প্রতিবেদন গায়েব করেছেন, তারাও সমান দোষী। তাই এসব বিষয় নিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। শুল্ক গোয়েন্দা এর আগে প্রশংসনীয় কিছু কাজ করলেও এই প্রতিবেদন কেন তারা খুঁজে পাবে না। এর পেছনে বড় ধরনের রহস্য রয়েছে কি না, তা তদন্তের মাধ্যমে উন্মোচন করা উচিত বলেও মনে করেন তিনি।

ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) হিসাবমতে, বাংলাদেশ থেকে মোট অর্থ পাচারের প্রায় ৮০ শতাংশ সংঘটিত হয় আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের আড়ালে। আমদানির ক্ষেত্রে পণ্যের অতিমূল্যায়ন বা ওভার-ইনভয়েসিং এবং রপ্তানির ক্ষেত্রে পণ্যের কম মূল্যায়ন অর্থাৎ আন্ডার-ইনভয়েসিং করে অর্থ পাচার করা হয়। কখনো কখনো পণ্য আমদানি-রপ্তানি না করে অবৈধ জাল কাগজপত্র তৈরি করে অর্থ পাচার হয়। আর অর্থ পাচার সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সর্বশেষ বৈঠকেও অর্থ পাচার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। ওই বৈঠকে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরাতে ট্যাক্স অ্যামনেস্টির মাধ্যমে কোনো অর্থ দেশে এসেছে কি না, তার খোঁজ নেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ মালয়েশিয়া ও কানাডায় নতুন করে অর্থ পাচার বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে অর্থ পাচার সংক্রান্ত্র টাস্কফোর্স কমিটির দেওয়া প্রতিবেদন হারিয়ে যাওয়া খুবই উদ্বেগজনক বলেও মনে করেন খোদ এনবিআরের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, গুরুত্বপূর্ণ এই রাষ্ট্রীয় নথি কীভাবে হারিয়ে যায়, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন।

এ বিষয়ে কথা বলতে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ফখরুল আলমের মোবাইল ফোনে বারবার কল দিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে খুদে বার্তা দিয়েও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

Share