নয়াবার্তা ডেস্ক : মহাবিশ্বের জন্ম হলো কীভাবে? একসময় এ প্রশ্নের উত্তর ছিল না। গ্রিক দার্শনিকদের অনেকেই মনে করতেন পৃথিবী আদি এবং অনন্ত। এর শুরু বা শেষ নেই। আর তাই মহাবিশ্বের শুরু এবং শেষ নিয়েও কোনো ব্যাখ্যা তাদের কাছে ছিল না। এমনকি বিংশ শতাব্দীতে এসেও এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা বিজ্ঞানীদের ছিল না।
১৯২০-এর দশকে নাটকীয় পরিবর্তন আসে। ১৯১৫ সালে আলবার্ট আইনস্টাইন প্রকাশ করেন তাঁর বিখ্যাত জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি বা সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব, একটিমাত্র সমীকরণের সাহায্যে। সেই সমীকরণে আইনস্টাইন দেখান মহাকর্ষ আসলে কোনো আকর্ষণ বল নয়। কোনো ভারী বস্তু স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দেয়। সেই বাঁকানো স্থান-কালের ভেতর যখন আরেকটা বস্তু এসে পড়ে, তখন মনে হয় প্রথম বস্তুটা দ্বিতীয়টাকে আকর্ষণ করছে। অর্থাৎ নতুন করে লেখা হয় মহাকর্ষের ইতিহাস।
এক লাইনের একটা সমীকরণ ছিল ওটা। তবে এর ছিল বহু সমাধান। একেকজন একেকভাবে সমাধান করেন। ১৯১৬ সালে জার্মান বিজ্ঞানী কার্ল সোয়ার্জশিল্ড একটা সমাধান বের করেন। সেই সমাধান থেকেই মানুষ বিজ্ঞানীরা পান ব্ল্যাকহোলের কথা। ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটন একটা পরীক্ষার মাধ্যমে জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির প্রমাণ পান। এরপর ছুটতে থাকে এই তত্ত্বের জয়রথ। ১৯২০-এর দশকে মার্কিন বিজ্ঞানী এডউইন হাবল দেখালেন, মহাবিশ্বে আরও গ্যালাক্সি আছে। এর আগে পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, গোটা মহাবিশ্বে একটিমাত্র গ্যালাক্সি, সেটা হলো আমাদের মিল্কিওয়ে। হাবলের এই আবিষ্কার নাটকীয়ভাবে বদলে দিল মহাবিশ্বের ইতিহাস ওই দশকেই রুশ বিজ্ঞানী আলেক্সান্ডার ফ্রিডম্যান প্রমাণ করলেন মহাবিশ্বের প্রতিটা বস্তু (আসলে গ্যালাক্সি) পরস্পরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। যে গ্যালাক্সি আমাদের থেকে যত দূরে, তার দূরে সরে যাওয়ার গতি তত বেশি। অর্থাৎ মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে সব সময়।
অবশ্য আইনস্টাইন নিজেই ওই প্রসারণ তত্ত্ব মানতে রাজি ছিলেন না। তাই তিনি কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট বা মহাজাগতিক ধ্রুবক যোগ করলেন তার সমীকরণে, যাতে কাগজে-কলমে মহাবিশ্বের প্রসারণ বন্ধ করা যায়। সেটা করলেন বটে, কিন্তু বাস্তবে যেটা প্রসারিত হচ্ছে, অঙ্কে গোঁজামিল দিয়ে সেটা বন্ধ করা যায় না। পর্যবেক্ষণ ও প্রমাণ বলছে মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে, আইনস্টাইন সেটা বন্ধ করতে চাইলেও তো বন্ধ হবে না।
মহাবিশ্ব সত্যি সত্যিই প্রসারিত হচ্ছে, কিন্তু কেন? বিজ্ঞানীদের মাথায় এল তখন নতুন ভাবনা। যেহেতু মহাবিশ্বের প্রতিটা গ্যালাক্সি একটা থেকে আরেকটা দূরে সরে যাচ্ছে, তার মানে এরা একসময় একসঙ্গে ছিল। সেখান থেকে কোনো এক বিস্ফোরণে এরা চারপাশে ছুটে যায়। অনেকটা বোমা ফাটার মতো ব্যাপার। বিস্ফোরণের পর বোমাটির ভেতরের পদার্থ যেগুলোকে আমরা স্প্লিন্টার বলি, সেগুলো ছড়িয়ে পড়ে। তা হলে মহাবিশ্বেও কি এমন কোনো ঘটনা ছিল? মহাবিশ্ব কি আগে একটাই বিন্দু ছিল, সেই বিন্দুতেই ঘটে বিস্ফোরণ। আর সেই বিস্ফোরণের পরেই জন্ম হয় বস্তুকণার, সময়ের বিবর্তনে সেসব বস্তু গ্রহ-নক্ষত্র, গ্যালাক্সি ইত্যাদিতে পরিণত হয়ে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ছে?
তেমনটাই বলেন রুশ-মার্কিন বিজ্ঞানী জর্জ গ্যামো আর রাফল আলফার। তারা সেই বিস্ফোরণের নাম দেন বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ। বিগ ব্যাং তত্ত্বের পক্ষে বড় প্রমাণ আদিম মাইক্রোওয়েভ বিকিরণ বা সিএমএমবিআর। ১৯৬৫ যুক্তরাষ্ট্রের বেল ল্যাবরেটরির দুই বিজ্ঞানী আর্নো পেনজিয়াস আর রবার্ট উইলসন পান সেই আদিম বিকিরণ সিএমবিআরের সন্ধান।
সুতরাং মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব আজ প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব। এই তত্ত্ব মতে, একটা সিঙ্গুলারিটি বা পরম বিন্দু থেকে বিস্ফোরণ হয়। সেই বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে যেমন মহাবিস্ফোরণের জন্ম, তেমনি জন্মস্থান ও কালের।
মহাবিস্ফোরণ মেনে নিতে কারও অসুবিধা নেই। এটা এখন প্রতিষ্ঠিত। সমস্যা হলো, সেই বিস্ফোরণের আগে তা হলে কী ছিল? এ প্রশ্ন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কিন্তু অনেক বিজ্ঞানীই এটাকে অবান্তর প্রশ্ন বলে উড়িয়ে দিতে চাইছেন। তাঁদের মতে, মহাবিস্ফোরণের আগে সময় বলে কিছু ছিল না। আর সময়ের অস্তিত্বই যেখানে নেই, সেখানে কোনো ঘটনাই ঘটতে পারে না। তাই বিগ ব্যাংয়ের আগে কী ছিল, সে প্রশ্ন তোলাই ঠিক নয়।
কিন্তু বিজ্ঞানে যেকোনো যৌক্তিক প্রশ্ন তোলার অধিকার সবার আছে। বর্তমান হলো অতীতের বিভিন্ন ঘটনার ফলাফল। একটা ঘটনার ফলাফল জন্ম দেয় আরেক ঘটনার। মহাবিশ্বের ইতিহাসের পেছন দিকে হাঁটলেই ঘটনা পরম্পরা দেখতে পাওয়া যায়। অতীতের একটা ঘটনা বর্তমানের কোনো ঘটনার কারণ। তেমনি অতীতের কোনো না কোনো ঘটনার ফলাফল হলো বর্তমানের কোনো ঘটনা।
তাই বলা নেই, কওয়া নেই, সময়ের বালাই নেই, হঠাৎ করে কোনো একটা ঘটনা ঘটে গেল? সবচেয়ে বড় কথা, আমরা যেটাকে শূন্যস্থান বলি, বা মহাশূন্য বলি, এগুলোর অবস্থান আমাদের এই মহাবিশ্বের মধ্যেই। তাই বিগ ব্যাংয়ের আগে যখন কিছুই ছিল না। তখন কী শূন্য-মহাশূন্য বলে কিছুই ছিল না? স্পেস বা স্থানই যদি না থাকে, তা হলে মহাবিস্ফোরণ ঘটল কোথায়?
শুধু মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বই নয়। এখন এর পাশাপাশি আরও দুটি তত্ত্ব দাঁড়িয়ে গেছে। ইনফ্লেশন বা স্ফীতি তত্ত্ব। তবে এটি মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বের সঙ্গে হাত ধরাধরি করেই চলছে। আরেকটি হলো বিগ বাউন্স। দুটি তত্ত্বই মহাবিশ্বের সৃষ্টি আর বিকাশের কথা যেমন বলছে, বলছে মহাবিস্ফোরণের আগের কথাও।
ইনফ্লেশন তত্ত্ব আসলে মহাবিশ্বের মহাস্ফীতির কথা বলে। মহাবিশ্বের জন্মের ১০৩০ সেকেন্ডের মধ্যে মহাবিশ্ব ১০৩৬ গুণ স্ফীত হয়ে ওঠে। আসলে এটাই এ তত্ত্বের শেষ কথা নয়! স্ফীতি তত্ত্ব থেকে বেরিয়ে আসে মাল্টিভার্স বা বহুবিশ্বের ধারণা। স্ফীতি তত্ত্বের জনক আল্যান গুথ গত শতাব্দীর আশির দশকে স্ফীতি তত্ত্বের প্রস্তাব করেন। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে স্ফীতি তত্ত্ব আজ জৌতিঃপদার্থবিদ্যার প্রতিষ্ঠিত এক তত্ত্ব।
সমাধান যাই হোক, বিগ ব্যাংয়ের আগে কী ছিল সেটা এক মস্ত প্যারাডক্স। কেউ কেউ বলেন, এর আগে আরেকটা মহাবিশ্ব ছিল, সেটি সংকুচিত হয়ে সিঙ্গুলারিটিতে পৌঁছায়। তা হলেও প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাই, সেই মহাবিশ্ব কীভাবে সৃষ্টি হলো? সেটা যদি আরেকটা বিগ ব্যাংয়ের মাধ্যমে জন্ম নেয়, তার আগে কী ছিল? এ প্রশ্নের জবাব নেই। মিথ বা পৌরাণিক মতে, অনেক জবাব পাবেন। কিন্তু বিজ্ঞান সম্মতভাবে এই প্যারাডক্সের কোনো সমাধান নেই।