চাইলে পাব না সেই অবস্থাটা আর নাই: ব্রিকসের সদস্য পদ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী

নয়াবার্ত‍া প্রতিবেদক : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এবারই ব্রিকসের সদস্যপদ পেতে হবে এমন কোনো চেষ্টা বাংলাদেশের ছিল না এবং বাংলাদেশ কাউকে সেটা বলেওনি। “চাইলে পাব না সেই অবস্থাটা আর নাই। কিন্তু প্রত্যেক কাজটারই একটা নিয়ম থাকে, আমরা সেই নিয়ম মেনেই চলি,” বলেছেন তিনি।

দক্ষিণ আফ্রিকায় পঞ্চদশ ব্রিকস সম্মেলনে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা জানাতে মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে আসেন সরকারপ্রধান। সেখানেই ব্রিকস নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দেন।

বিশ্ব অর্থনীতির এক-চতুর্থাংশের নিয়ন্ত্রণকারী পাঁচ দেশের জোট ব্রিকসের সম্মেলনে যোগ দিতে এবার দক্ষিণ আফ্রিকা সফর করেন শেখ হাসিনা।

এবারের সম্মেলনের আগেই বাংলাদেশের সদস্য হওয়ার আবেদনের বিষয়টি আলোচনায় ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এর আগে এ বিষয়ে আগ্রহের কথা বলেছিলেন।

সম্মেলনে শেষ পর্যন্ত ৬ দেশকে ব্রিকসে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হলেও বাংলাদেশ সেই তালিকায় নেই, যা নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলছে। বিএনপি বিষয়টিকে বর্ণনা করেছে সরকারের ‘কূটনৈতিক ব্যর্থতা’ হিসেবে।

সংবাদ সম্মেলনে একজন সাংবাদিক ব্রিকসে বাংলাদেশের সুযোগ না পাওয়া এবং এ বিষয়ে চলমান আলোচনার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। জবাবে প্রধানমন্ত্রী গত জুন মাসে তার ইতালি সফরের সময় দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাতে ব্রিকসে নতুন সদস্য নেওয়ার আলোচনার বিষয়টি তুলে ধরেন।

শেখ হাসিনা বলেন, “আমার সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎ হল, তখন আমন্ত্রণ জানালেন, ব্রিকস সম্মেলন করবে, আমাকে আসতে বললেন এবং সে সময় আমাকে জানালেন যে, তারা কিছু সদস্যপদ বাড়াবেনও এবং সেটাতে আমার মতামত জানতে চাইলেন। “আমি বললাম যে, এটা খুবই ভালো হবে। কারণ ব্রিকস যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন থেকে এই পাঁচটা দেশের সরকারের প্রধানের সঙ্গে আমার যোগাযোগ সবসময় ছিল এবং আছে।”

গত জুন মাসে জেনিভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ব্রিকসের সভাপতি দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার বৈঠক হয়।

ওই বৈঠকের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, বাংলাদেশের ব্রিকসে যোগদানের বিষয়ে সেখানে আলোচনা হয়েছে। এরপর জুনের মাঝামাঝিতে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিকসের সদস্যপদের জন্য আবেদন করে সরকার।

চলতি মাসের ২৪ তারিখ ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আমন্ত্রিত হয়ে যোগ দেন। এই সম্মেলনেই ছয়টি দেশকে নতুন করে ব্রিকসের সদস্য হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত হয়। সেগুলো হল- আর্জেন্টিনা, মিশর, ইথিওপিয়া, ইরান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।

দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে জুনে যে আলোচনা হয়, সেই পর্যায়েই বিষয়টি ছিল বলে জানান সরকারপ্রধান। তিনি বলেন, “ব্রিকসের সদস্য হওয়ার বিষয়ে প্রেসিডেন্ট আমাকে তখনই বলেছিলেন যে, ধাপে ধাপে নেবেন, তারা ওই ভৌগোলিক অবস্থানকে বিবেচনা করে যে দেশগুলি তাদেরকে নেবেন এবং পর্যায়ক্রমিকভাবে তারা সদস্য সংখ্যা বাড়াবেন। “আমরা ঠিক ওইভাবে… হ্যাঁ, নিলে আমরা খুব খুশি। কিন্তু আমরা ঠিক ওইভাবে ব্রিকসে এখনই সদস্যপদ পাব, এই প্রথমবারই যে সদস্যপদ পাব, এ ধরনের চিন্তা আমাদের মাথায় ছিলও না, আর সেই রকম চেষ্টাও কিন্তু আমরা করিও নাই বা কাউকে আমরা বলিও নাই।”

ব্রাজিল ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা কিন্তু কাউকে কিছু বলতে যাইনি যে, এখনি মেম্বার করেন। তখন থেকে আমরা জানি যে তারা কয়েকটা দেশ নেবেন।”

ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ অন্য সরকারপ্রধানদের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজেও সদস্যপদ নিয়ে আলোচনার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “ওই সময় আলোচনা হয়, ‘এখন আমরা এই কয়জন নেব। এরপরে ধাপে ধাপে আমরা আরও সদস্য সংখ্যা বাড়াব’; এই।”

বিরোধীদলের সমালোচনার জবাব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা জানি, এই ইস্যুটা আসবে বা আমাদের অপজিশান থেকে খুব হুতাশ, যে আমরা নাকি চেয়েছি, পাইনি, হেনতেন।

“বাংলাদেশ কিছু চেয়ে পাবে না এটা কিন্তু ঠিক না। অন্তত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের যে মর্যাদাটা আমরা তুলে ধরেছি, সেখানে আমাদের সেই সুযোগটা আছে।”

তিনি বলেন, “তারা বলতে পারে, কারণ তারা বিএনপির আমলে ওইটাই ছিল। বাংলাদেশের কোনো অবস্থানই ছিল না সারাবিশ্বে। বাংলাদেশ মানেই ছিল দুর্ভিক্ষের দেশ, ঝড়ের দেশ, বন্যার দেশ, হাত পেতে চলার দেশ, ভিক্ষা চাওয়ার দেশ। এখন অন্তত বাংলাদেশ ভিক্ষা চাওয়ার দেশ না, এটা সবাই জানে।”

প্রধানমন্ত্রী জানান, ব্রিকস জোটের অধীনে গঠিত নিউ ডেভেলপমন্টে ব্যাংকে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ শুরু থেকেই বাংলাদেশের ছিল এবং বাংলাদেশ ওই ব্যাংকের সদস্য হয়েছে। “আমাদের পক্ষ থেকে আমরা যখন শুনলাম যে, নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক হচ্ছে, ওটার উপরে আমাদের আগ্রহটা বেশি ছিল, সেখানে আমরা যুক্ত হতে চেয়েছিলাম।” ওই ব্যাংকের অর্থায়নে বাংলাদেশে দুটি প্রকল্প চালু থাকার কথাও আরেক প্রশ্নে তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। বিনিময়ের ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট মুদ্রার বাধাধরা না থাকার কথাও তিনি বলেন।

নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার কারণে বিশ্বের দক্ষিণের দেশগুলো কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা ব্রিকস সম্মেলনে বাংলাদেশ তুলে ধরেছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

দক্ষিণ আফ্রিকা সফর নিয়ে মঙ্গলবার আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “দক্ষিণের দেশসমূহের উপর আরোপিত সিদ্ধান্ত, বিভাজনের নীতিকে না বলার এখনই সময়।

“সর্বজনীন নিয়ম ও মূল্যবোধকে অস্ত্রে পরিণত করার প্রচেষ্টাকে অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করতে হবে। আমাদের নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার চক্র বন্ধ করতে হবে।”

সব ধরনের হুমকি, উসকানি ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলার উপর গুরুত্ব দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “দক্ষিণের দেশসমূহের উপর আরোপিত কৃত্রিম সিদ্ধান্তের কারণে আর ক্ষতিগ্রস্ত হতে রাজি নই।

“সর্বজনীন নিয়মের নামে আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া অসম নীতিকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য আমি দক্ষিণের দেশসমূহকে আহ্বান জানিয়েছি।”

সফরের মূল আলোচনার বাইরে ইন্দোনেশিয়া, বেলারুশসহ বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানের সঙ্গে আলোচনা হওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমাদের এই সফরটা অত্যন্ত ফলপ্রসূ ছিল বাংলাদেশের জন্য।

“যখন সারাবিশ্ব স্যাংশন, কাউন্টার স্যাংশনের নামে নানা ঝামেলায়, সেখানে একটা নতুন দুয়ার খুলে গেছে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু সম্প্রসারণ করার জন্য সেটাই আমি মনে করি।”

বিপদজনক অস্ত্র প্রতিযোগিতায় সম্পদ অপচয় না করে বিশ্বব্যাপী জনসাধারণের জন্য পণ্য ও পরিষেবা প্রদানের জন্য আহ্বান সম্মেলনে জানানো হয়েছে বলে জানান শেখ হাসিনা।

বিশ্ব অর্থনীতির এক-চতুর্থাংশের নিয়ন্ত্রণকারী পাঁচ দেশের জোট ব্রিকসের সম্মেলনে যোগ দিতে দক্ষিণ আফ্রিকা সফর করেন শেখ হাসিনা।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুই ইনাসিও লুলা দা সিলভা জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে যোগ দেন।

২৩ অগাস্ট প্রধানমন্ত্রী হোটেল হিলটন স্যান্ডটনে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। ব্রিকসের বর্তমান চেয়ার দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট আয়োজিত ‘রাষ্ট্রীয় ভোজ’ এ যোগ দেন শেখ হাসিনা।

পরদিন ‘ব্রিকস-ফ্রেন্ডস অব ব্রিকস লিডার্স ডায়লগ (ব্রিকস- আফ্রিকা আউটরিচ অ্যান্ড দ্য ব্রিকস প্লাস ডায়লগ) এ ‘নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অব ব্রিকস’র সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষে বক্তৃতা দেন শেখ হাসিনা।

ব্রিকস সম্মেলনের ফাঁকে স্যান্ডটন কনভেনশন সেন্টারে শেখ হাসিনার সঙ্গে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুই ইনাসিও লুলা দা সিলভা, মোজাম্বিকের প্রেসিডেন্ট ফিলিপে জ্যাকিন্টো নিউসি, তানজানিয়ার প্রেসিডেন্ট ডক্টর সাইমা সুল্লুহু এবং ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট দিলমা ভানা রৌসেফের সঙ্গেও বৈঠক করেন তিনি।

ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দেওয়ার পাশাপাশি জোহানেসবার্গে বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী।

২৩ অগাস্ট ‘বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড বিজনেস সামিট’ এ প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন শেখ হাসিনা। একই দিন আফ্রিকার দেশগুলোতে নিযুক্ত বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতদের নিয়ে ‘বাংলাদেশ এনভয় কনফারেন্সে’ বক্তব্য রাখেন।

সফরকালে শেখ হাসিনা দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের আয়োজনে নাগরিক সংবর্ধনায়ও যোগ দেন। জোহানেসবার্গের হোটেল হিলটন স্যান্ডটনে শনিবার সরকার প্রধানের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকা আওয়ামী লীগের নেতারা দেখা করেন।

দক্ষিণ আফ্রিকা সফর শেষে রোববার সকালে ঢাকায় ফেরেন প্রধানমন্ত্রী।

Share