ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৯ হাজার ৯৫১ কোটি ১৭ লাখ টাকা

গাজী আবু বকর : ব্যাংক বহির্ভূত ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) এর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৯৫১ কোটি ১৭ লাখ টাকা। যা আগের বছরের তুলনায় ৪ হাজার ১৫ কোটি টাকা অর্থাৎ ২৫ দশমিক ২ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুন শেষে এ খাতে খেলাপির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে মোট ঋণের ২৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে যেসব কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে, এই খাতে প্রকৃত খেলাপি ঋণ তার চেয়ে অনেক বেশি।’ তিনি আরও বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিদর্শনে গেলে তখন কিছু এনবিএফআইয়ের খেলাপি ঋণ বেড়ে যায়।’

বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান গোলাম সারওয়ার ভূঁইয়া বলেন, ‘শুধু এনবিএফআই নয়, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি এখন একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এ কারণে এই খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে।’ তিনি বলেন, ‘গত বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ পরিশোধে করোনার সময়ে দেওয়া সুবিধা প্রত্যাহার করার পর মন্দ ঋণ বেড়েছে।’ গোলাম সারওয়ার ভূঁইয়া ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স কোম্পানির (আইআইডিএফসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বও পালন করছেন। তিনি বলেন, ‘চলমান অর্থনৈতিক সংকটকে অজুহাত দেখিয়ে ঋণগ্রহীতারা ঋণ পরিশোধ করছেন না। তাই ঋণ আদায়ে আমরা অসুবিধায় পড়ছি।’

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা জানান, এ খাতে বিপুল পরিমাণ ঋণ অনিয়ম ও কেলেঙ্কারির কারণে দুর্বল এনবিএফআইয়ের সংখ্যা বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট বলছে, গত বছর ৩৫টি এনবিএফআইয়ের মধ্যে ১৪টি রেড জোনে ছিল, যা ২০২১ সালের ১২টির চেয়ে বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এজন্য মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংক দায়ী।’ তিনি বলেন, এনবিএফআইয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি ব্যাংকগুলোর মতো মানসম্মত নয়। যা গত কয়েক বছরে এই খাতের কেলেঙ্কারি ও ঋণ অনিয়মের ঘন ঘন রিপোর্টে ফুটে উঠেছে। দুর্বল এনবিএফআইগুলোর পাঁচ থেকে ছয়টি বন্ধ এবং আরও অর্ধ ডজন এনবিএফআইকে একীভূত করার পরামর্শ দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে এত বেশি ব্যাংক ও এনবিএফআই যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে সবগুলো তদারকি করা বেশ কঠিন।’ সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।

অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘কিছু এনবিএফআই অস্বাভাবিক বেশি মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে মানুষকে প্রতারিত করে।’ ‘আমানতকারীদের অর্থ রক্ষায় কিছু এনবিএফআই বন্ধ করার এটাই সঠিক সময়। না হলে সাধারণ মানুষ প্রতারণার শিকার হতে থাকবে,’ যোগ করেন তিনি। ব্র্যাক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, আর্থিকভাবে অসচ্ছল অন্তত ১০টি এনবিএফআইকে আমানতকারীর অর্থ সংগ্রহ থেকে বিরত রাখতে হবে। তিনি আরও বলেন, ‘এসব এনবিএফআইকে ব্যবসা চালু রাখতে হলে আগে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে হবে।’

২০২০ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি পরিদর্শন দল এক ডজন এনবিএফআইতে ব্যাপক অনিয়ম ও কেলেঙ্কারির সন্ধান পান। এগুলোর মধ্যে আছে- পিপলস লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (আইএলএফএসএল), প্রিমিয়ার লিজিং, উত্তরা ফাইন্যান্স ও ফার্স্ট ফাইন্যান্স। পিকে হালদার আইএলএফএসএলের এমডি ছিলেন। অভিযোগ আছে- তিনি পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ও এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছিলেন। পিপলস লিজিং ২০১৯ সালের জুনে লিকুইডেশনের মুখোমুখি হয়েছিল, কারণ তহবিলের মেয়াদ পূর্তি সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানটি আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু, এটিকে বিলুপ্ত করার পরিবর্তে পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার, যা এই খাতের সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

Share