রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ১৯ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার

বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘স্বস্তিদায়ক’ বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক

নয়াবার্ত‍া প্রতিবেদক : দেশে বর্তমানে নিট রিজার্ভ ১৯ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। গতকাল বৃহষ্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ২৫ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার বা ২ হাজার ৫১৬ কোটি ১৩ লাখ ৪০ হাজার ডলার। আর আইএমএফের শর্তানুযায়ী, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে গঠিত তহবিলের অর্থ ৫ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার বাদ দিলে বিপিএম-৬ ম্যানুয়াল অনুযায়ী গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৯ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার। অথচ গত মঙ্গলবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছিলো, বৈদেশিক মুদ্রার বর্তমান মজুত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিপিএম-৬ অনুযায়ী প্রায় ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি। যা ‘স্বস্তিদায়ক’। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আগামী জানুয়ারি মাসের মধ্যে দেশের মূল্যস্ফীতি পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে ৮ শতাংশে এবং আগামী জুন শেষ নাগাদ ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষনে দেখা যায়, চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে গত ৭ নভেম্বর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসের আমদানি বিল বাবদ ১২১ কোটি ডলার পরিশোধ করায় প্রকৃত রিজার্ভ কমে ১৯ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঐসময়কার তথ্যানুযায়ী, দেশে গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ছিলো ২৬ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার বা ২ হাজার ৬৪২ কোটি ৬৩ লাখ ডলার। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে গঠিত তহবিলের অর্থ ৫ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার বাদ দিলে বিপিএম-৬ ম্যানুয়াল অনুযায়ী গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ছিলো ২০ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন। এখান থেকে আকুর বিল পরিশোধের পর দেশের রিজার্ভ কমে ১৯ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলারে নেমেছিলো।

দেশের বিদ্যমান রিজার্ভ পরিস্থিতি যখন এমনই হ-য-ব-র-ল অবস্থা ঠিক তখনই বাংলাদেশ ব্যাংক গত ২১ নভেম্বর মঙ্গলবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছিলো, বৈদেশিক মুদ্রার বর্তমান মজুত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিপিএম-৬ অনুযায়ী প্রায় ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি। এ রিজার্ভ দিয়ে প্রায় চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। এটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী যে কোনো অর্থনীতির জন্য স্বস্তিদায়ক। বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়, গত বছরের প্রায় ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি কাটিয়ে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের মত উদ্বৃত্ত হয়েছে। তবে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের আগের স্বস্তিদায়ক উদ্বৃত্ত অবস্থা থেকে ঘাটতি পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার কারণে সার্বিক বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যে এখনো কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যে শিগগির একটা স্বস্তিদায়ক অবস্থা ফিরে আসবে বলে নিয়ন্ত্রণ সংস্থাটি আশা করে।

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণসহ মুদ্রা বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা আনতে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের সময়োপযোগী ও কার্যকর নীতি গ্রহণের ফলে বর্তমানে বিদ্যমান মুদ্রা বিনিময় হার প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হার সূচকের সঙ্গে অনেকটাই সঙ্গতিপূর্ণ রয়েছে। এক্ষেত্রে, আগামীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি তাদের নীতি সুদহার আর না বাড়ায় কিংবা হ্রাস করে তাহলে আমাদের বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা আনতে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং এর প্রত্যাশাকে ধরে রাখার বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। একই সঙ্গে সরকার অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় সংকোচন করেছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর মূল্যস্ফীতির অভিঘাত নিরসনে সামাজিক নিরাপত্তা জালের আওতা ও ব্যাপ্তি বাড়ানো হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বাংলাদেশ সরকারের সংকোচনমূলক যুগপৎ নীতি পদক্ষেপ এবং উৎপাদন ও বিনিয়োগ সহায়ক নীতির ফলে মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতির আশু উন্নতি হবে।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আগামী জানুয়ারি মাসের মধ্যে দেশের মূল্যস্ফীতি পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে ৮ শতাংশে এবং জুন শেষ নাগাদ ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করে, আগামী সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন হওয়ার পর অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হবে এবং অর্থবছরের শেষ নাগাদ দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, সাম্প্রতিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলা করে দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করতে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সরকার উভয়েই আর্থিক ও রাজস্ব খাতে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি সাপেক্ষে শিগগির দেশের রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের প্রবাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির বৈদেশিক খাতে স্থিতিশীলতা এবং মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতিতে একটা স্বস্তিদায়ক অবস্থা ফিরে আসবে বলে আশা করা যায়। দ্রুত পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক ভূ-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণে নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে আগামীতে বাংলাদেশ আরও শক্তিশালী অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে বলে আশা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।

ডলারের দাম কমানোর বিষয়ে আজ বৃহষ্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে ডলারের দাম কমানোর সিদ্ধান্তে সমর্থন জানানো হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, চাহিদা ও জোগানের ওপর নির্ভর করে ডলারের দাম নির্ধারণ করা হয়। ডলার খরচ হয় সেবা ও পণ্য ক্রয় এবং ঋণ ও বিদেশি দায় মেটাতে। এখন আমদানি মূল্য তদারক করা হচ্ছে। ফলে সঠিক পরিমাণে ডলার খরচ হচ্ছে। এতে ডলারের চাহিদা কমেছে। অন্যদিকে বিদেশি দায়ও কমে এসেছে। ভবিষ্যতে বিদেশি ঋণ আসবে, যাতে রিজার্ভ বাড়বে। এ কারণে ডলারের দাম কমানোর সিদ্ধান্তটি সঠিক ও সময়োপযোগী।

মেজবাউল হক জানিয়েছেন, দেশের ২১টি ব্যাংক ডলার সংকটে ভুগছে। সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো বিভিন্ন ব্যাংকের কাছ থেকে ডলার সংগ্রহ করে চলছে। তবে সার্বিকভাবে ডলারের সংকট নেই।

তিনি বলেন, গত বছরে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণের দায় ছিল ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার, এখন যা কমে হচ্ছে ৬৯০ কোটি ডলার। পাশাপাশি চলতি হিসাবে ১০০ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত রয়েছে। এখন ঋণপত্র খোলা হচ্ছে তাৎক্ষণিক ডলার পরিশোধের মাধ্যমে। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোতে ডলারের চাহিদার চেয়ে জোগান এখন বেশি। ফলে বাফেদার সিদ্ধান্তটি সঠিক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের একদিন পর বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) এবং অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে ডলার ক্রয় বিক্রয়ে ৫০ পয়সা মূল্য হ্রাস করে। অর্থাৎ প্রবাসী ও রপ্তানি আয় কেনায় ডলারের দাম ৫০ পয়সা কমিয়েছে। পাশাপাশি আমদানিকারকের কাছে ডলার বিক্রিতেও দাম কমবে ৫০ পয়সা। গত বুধবার সন্ধ্যায় অনলাইনে অনুষ্ঠিত মাত্র ৫ মিনিটের সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রবাসী ও রপ্তানি আয় কিনতে ডলারের দাম হবে সর্বোচ্চ ১১০ টাকা। আগে যা ছিল ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। আর আমদানি দায় মেটাতে ডলারের দাম নেওয়া যাবে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। আগে যা ছিল ১১১ টাকা। তবে প্রবাসী আয়ে সরকারের ২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রণোদনার পাশাপাশি ব্যাংকও একই পরিমাণ প্রণোদনা দিতে পারবে। ফলে প্রবাসী আয় পাঠালে ডলার প্রতি সর্বোচ্চ ১১৫ টাকা পাবেন উপকারভোগীরা। ডলারের জোগান ও চাহিদার ওপর নির্ভর করে সময়ে সময়ে এই সংগঠন দুটি ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ করে আসছে। এ দুটি সংগঠন মূলত বাণিজ্যিক ব্যাংক সংশ্লিষ্ট। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে তারা সময়ে সময়ে ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব পালন করছে। তবে এ দুই সংগঠন ডলারের দর নির্ধারণের দায়িত্ব নেওয়ার পর মার্কিন এই মুদ্রার দাম আগের তুলনায় কখনো কমানো হয়নি।

এই যখন অবস্থা তখন ব্যাংকগুলো আজও প্রবাসী আয়ে ডলার ১২১ টাকার বেশি দামে কিনেছে বলে জানা গেছে। যেসব ব্যাংক অতিরিক্ত দামে প্রবাসী আয় কিনেছে, শুধু তারাই এখন ডলার পাচ্ছে। আর ১১০ টাকার বেশি দাম না দেওয়ায় সরকারি ব্যাংকগুলো এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে। অনেক ব্যাংক কোনো প্রবাসী আয় কিনতে পারছে না।

উল্লেখ্য, রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয়, বিদেশি বিনিয়োগ, বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার ঋণ থেকে যে ডলার পাওয়া যায়, তা দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তৈরি হয়। আবার আমদানি ব্যয়, ঋণের সুদ বা কিস্তি পরিশোধ, বিদেশি কর্মীদের বেতন-ভাতা, পর্যটক বা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনাসহ বিভিন্ন খাতে যে ব্যয় হয়, তার মাধ্যমে বিদেশি মুদ্রা চলে যায়। এভাবে আয় ও ব্যয়ের পর যে ডলার থেকে যায় সেটাই রিজার্ভে যোগ হয়। আর বেশি খরচ হলে রিজার্ভ কমে যায়। সম্প্রতি বৈশ্বিক উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বৈদৈশিক মুদ্রায় টান পড়ে। সেই সাথে কমতে থাকে প্রবাসী আয়। সরকারের জ্বালানি, খাদ্য আমদানি ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে হয় রিজার্ভ থেকে। এর ফলে আশঙ্কাজনকভাবে কমতে থাকে রিজার্ভ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত বছরের মার্চ থেকে দেশে ডলার-সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। যা এখনো অব্যাহত আছে। এ সংকট দিন দিন বাড়ছে। বাজারে ‘স্থিতিশীলতা’ আনতে রিজার্ভ থেকে নিয়মিত ডলার বিক্রি করে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছরে এরই মধ্যে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের মতো বিক্রি করা হয়েছে। ফলে ধারাবাহিকভাবে কমছে অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচকটি।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বেশকিছু বিষয়ে নির্দিষ্ট শর্ত দিয়ে বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে চলতি বছরের জানুয়ারির শেষের দিকে। এই ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার গত ফেব্রুয়ারিতে পায় বাংলাদেশ। এই শর্তের মধ্যে অন্যতম ছিল জুনে প্রকৃত রিজার্ভ ২ হাজার ৪৪৬ কোটি ডলার। সেপ্টেম্বরে তা ২ হাজার ৫৩০ ডলার এবং ডিসেম্বরে ২ হাজার ৬৮০ ডলারে রাখার কথা ছিল। কিন্তু পরে এসব শর্ত শিথিল করেছে সংস্থাটি। তারপরও প্রত্যাশিত রিজার্ভ রাখা নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনি।

Share