কোটা সংস্কারের আন্দোলনের তান্ডবে এমপি-মন্ত্রীরা এলাকায় ছিলেন না

নয়াবার্তা প্রতিবেদক : সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের ছাত্র আন্দোলনের কমপ্লিট শাট ডাউনের সুযোগে দেশব্যাপী বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসী তান্ডবের সময় আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রীরা মাঠে ছিলেন না। কোথাও কোথাও ছিলেন নীরব দর্শক। সহিংস তান্ডবের সময়ে এমপি-মন্ত্রীদের অনেকেই ছিলেন নিরাপদ আশ্রয়ে। কেউ কেউ নিজ বাসা বা অফিসে বসে টেলিভিশনে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছেন। পরিস্থিতি ঘোলাটে দেখে কেউ কেউ অসুস্থতার কথা বলে পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশে। কেউ ছিলেন হাসপাতালে। পরিস্থিতির অবনতি দেখে কেউ কেউ মন্ত্রীপাড়ার বাসা কিংবা ন্যামভবন থেকে বাইরে বের হননি। রাজধানী, বিভাগীয় শহরসহ সারা দেশেই একই চিত্র পাওয়া গেছে। হাতে গোনা কয়েকজন মন্ত্রী-এমপির উপস্থিতি কেবল ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের আওয়ামী লীগের প্রধান কার্যালয় ও দলীয় সভানেত্রীর ধানমন্ডি কার্যালয়ে লক্ষ্য করা গেছে। এ রকম দুটি কার্যালয়ই অরক্ষিত ছিল।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, তান্ডবের সময়ে যদি এমপি-মন্ত্রীরা নিজ নিজ কর্মীবাহিনী নিয়ে মাঠে থাকতেন তাহলে সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধ করাসহ রক্ষা করা যেত রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ও স্থাপনাগুলো। এমনকি আওয়ামী লীগের অফিস, প্রভাবশালী নেতা-মন্ত্রীদের বাসাবাড়িতে হামলা হতো না। টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দেউলিয়াপনা ফুটে উঠত না। এমপি-মন্ত্রীই নয়, দায়িত্বশীল নেতারাও ছিলেন গা ঢাকা দিয়ে। সংকটের সময়ে নিজেদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ থাকার বদলে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে আওয়ামী লীগের কর্মীবাহিনী। আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড এমপি-মন্ত্রী ও দলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা নেতাদের কর্মকান্ডে ক্ষুব্ধ।

কোটা আন্দোলন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১৬ জুলাই আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এতে মারাও যান কয়েকজন। ওই দিন রাজধানীসহ অধিকাংশ এলাকায় এমপিরা খন্ড খন্ড মিছিল করে নিজেদের অবস্থান জানান দেন। কেউ কেউ লাঠি হাতে বিক্ষোভ মিছিল করে সেগুলো নিজেদের ফেসবুকেও পোস্ট করেন। জেলা শহরগুলোতেও একই চিত্র চোখে পড়ে। পরদিন ১৭ জুলাই থেকে পরিস্থিতি বেশি খারাপ হয়। ওইদিন আরও অনেকেই মারা যান। এরপর থেকেই এমপি-মন্ত্রীরা লাপাত্তা হয়ে যান। তাদের অনেকেই ফোন বন্ধ করে রাখেন। বিশেষ করে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, রংপুর, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, মাদারীপুরে এমপি-মন্ত্রীদের দেখা যায়নি। এসব জায়গায় তান্ডব চালায় বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা। এতে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দুর্বলতা চরমভাবে ফুটে ওঠে।

অন্যদিকে বিগত সংসদ নির্বাচনের সময়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের উন্মুক্ত করে দেওয়ার ফলেও অনেক জায়গায় সাংগঠনিক অবস্থা দুর্বল হয়েছে। যেখানে স্বতন্ত্ররা বিজয়ী হয়েছেন, সেখানে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এমপির সঙ্গে কম আছে। আবার কোনো কোনো জায়গায় আওয়ামী লীগের এমপি নির্বাচিত হলেও সাবেক এমপি-মন্ত্রীদের দাপট সেখানে বেশি। সে কারণে বর্তমান এমপিদের সঙ্গে তেমন নেতা-কর্মীও নেই। যার কারণে এমপি-মন্ত্রীরা গা ঢাকা দিয়েছেন।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী ফোরামের নেতারা জানান, দীর্ঘদিন ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের ওয়ার্ড-থানার কমিটি না থাকায় নেতা-কর্মীরা ঝিমিয়ে পড়েছেন। যে কারণে শনিরআখড়া, রায়েরবাগ, যাত্রাবাড়ী, মালিবাগ আবুল হোটেল, রামপুরায় বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাড্ডা, নতুন বাজার, প্রগতি সরণি, কুড়িল, খিলক্ষেত, উত্তরা, উত্তরখান, দক্ষিণখান, মিরপুর ১০ নম্বর ও কাজীপাড়া মেট্রোরেল স্টেশন, মোহাম্মদপুর, শংকর, ধানমন্ডি, জিগাতলা, আসাদগেট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, গুলিস্তান, বনানীর সেতু ভবন, জাতীয় দুর্যোগ ভবন, ডেটা সেন্টার, স্বাস্থ্য অধিদফতরসহ বিভিন্ন এলাকায় তান্ডব করতে পেরেছে নাশকতাকারীরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকেই আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রীদের সঙ্গে কর্মীদের দূরত্ব বাড়তে থাকে। কেউ কেউ এলাকায় গড়ে তুলেছেন এমপি লীগ, আত্মীয় লীগ। পরীক্ষিত ও দুর্দিনের নেতা-কর্মীদের সরিয়ে হাইব্রিডদের নিয়ে করেছেন কমিটি। হাইব্রিড নেতারা এমপি-মন্ত্রীদের ওপর ভর করে কেউ কেউ হয়েছেন টাকার কুমির। যে কারণে টাকা বাঁচাতে তারাও মাঠে নামেননি। দুঃসময়ের পরীক্ষিত কর্মীরা নিজ তাগিদে মাঠে নামলেও তারা স্থানীয় এমপি-মন্ত্রীদের কাছে ভিড়েননি। আর এমপি-মন্ত্রীদের স্বজন লীগ, প্রটোকল লীগকে মাঠে নামানো যায়নি। আগের দিনে দলের নেতা-এমপি-মন্ত্রীরা ছিলেন যেমন কর্মিবান্ধব, তেমনি কর্মীরাও নেতার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত ছিলেন। এখন সেই সংস্কৃতি উঠে যেতে বসেছে। নেতা-কর্মীদের ওপর যখন নির্যাতন করা হয়েছে ওইসব নেতারাও ঢাল হয়ে কর্মীদের বাঁচিয়েছেন। বর্তমানে সেটা নেই। এখন সেলফি সংস্কৃতিতে শেষ হচ্ছে মাঠের রাজনীতি। কিছু সময় মাঠে থেকে ছবি তুলে সেলফি দিয়েই দায়িত্ব শেষ করছেন কেউ কেউ।

মাঠপর্যায়ের নেতারা বলছেন, নির্বাচনি এলাকার এমপিদের আমরা অভিভাবক হিসেবে মানি। সঠিক দিকনিদের্শনা না পেলে আমরা কী করব। বিগত কয়েক দিনের কোটাবিরোধী আন্দোলনে অনেক এমপি-মন্ত্রীই গা ঢাকা দিয়েছিলেন। যে কারণে সঠিক নির্দেশনা না পাওয়ায় তেমন প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়নি। তারা আরও জানিয়েছেন, সংকটের সময়ে যারা দলকে অনিরাপদ রেখে নিজে নিরাপদ থাকতে চায় আগামীতে দলীয় মনোনয়নের সময়ে দলের হাইকমান্ডকে চিন্তাভাবনা করেই মনোনয়ন দেওয়া প্রয়োজন।

Share