পালাবদলে ব্যাংক খাতে চরম বিশৃঙ্খলা

নয়াবার্তা প্রতিবেদক : ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের ব্যাংক খাতে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। গভর্নরের আত্মগোপনে চলে যাওয়া, তিন ডেপুটি গভর্নরসহ অন্তত ৬ জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার পদত্যাগের পর নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে বাংলাদেশ ব্যাংক। নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের এমন অচলায়তনে অস্থিরতা বিরাজ করছে অধীনস্থ ব্যাংকগুলোতেও। কোথাও চলছে পাল্টাপাল্টি দখলের খেলা, আবার কোথাও ঘটছে বিক্ষোভ এবং শীর্ষ কর্মকর্তাকে অবরুদ্ধ করার ঘটনা। ১৩ আগস্ট অহসান এইচ মনসুরকে নতুন গভর্নর নিয়োগ দেয়া হয়েছে।এখনো ব্যাংক খাতে বিরাজ করছে চরম বিশৃঙ্খলা। শৃঙ্খলো ফেরাতে সময় লাগব।

গত রোববার রাজধানীর দিলকুশায় ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে হামলা চালিয়েছে অস্ত্রধারীরা। এ হামলায় ব্যাংকটির ৬ কর্মকর্তা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাঁদের দুজনের পরিচয় জানা যায়নি। বাকি চারজন হলেন শফিউল্লাহ, আবদুল্লাহ আল মামুন, আব্দুর রহমান ও বাকিবিল্লাহ। তাঁরা বর্তমানে ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

ইসলামী ব্যাংকে অস্ত্রধারীদের এমন হামলার জন্য এস আলম গ্রুপকে দায়ী করেছেন ব্যাংকটির পুরোনো কর্মীরা। তাঁদের অভিযোগ, এস আলম গ্রুপের মদদপুষ্ট বিতাড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এই হামলা করেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৬ আগস্ট ইসলামী ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপের নিয়োগ করা কর্মকর্তাদের বের করে দেন পুরোনো কর্মকর্তারা। এরপর ৭ ও ৮ আগস্টও ব্যাংকারদের বিক্ষোভ করতে দেখা যায় ব্যাংকটিতে।

এ সময় কর্মকর্তারা ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠনের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে লুটেরাদের বের করে দেওয়ার দাবি জানান; পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুল মাওলা, অ্যাডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর কাউসার আলী, ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর আকিজ উদ্দিন, মিফতাহ উদ্দিনসহ এস আলমের নিয়োগ করা কর্মকর্তাদের ব্যাংক থেকে বহিষ্কারের দাবিও জানান তাঁরা। এর জেরে গতকাল ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে অস্ত্রধারীদের গুলির ঘটনা ঘটে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসলামী ব্যাংকের সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট (এসএভিপি) ড. শওকত আলী বলেন, ‘গতকাল জানতে পারি, এস আলমের বিভিন্ন কোম্পানি ও ব্যাংকের যারা আছে, তারা একত্র হয়ে ইসলামী ব্যাংক দখলের পরিকল্পনা করছে। এ তথ্য পেয়ে তারা যাতে ব্যাংকে না ঢুকতে পারে, সে জন্য ব্যাংকের সামনে আমরা অবস্থান নিই। একপর্যায়ে এস আলমের লোকজন সিটি সেন্টারে অবস্থান নেয়। তারা মিছিলসহ প্রধান কার্যালয়ে প্রবেশ করতে চায়। তখন ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারা তাদের প্রতিহত করতে গেলে এস আলমের লোকজন তাদের দিকে গুলি চালায়। এতে আমাদের ছয়জন গুলিবিদ্ধ হয়। তারা আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি আছে।’

ইসলামী ব্যাংকে এমন হামলার ঘটনা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ইসলামী ব্যাংকে গোলাগুলির ঘটনা সহ্য করা হবে না। কেউ আইনের বাইরে থাকবে না।’

এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকেও বিক্ষোভকারী কর্মকর্তাদের চাপের মুখে ৩ ডেপুটি গভর্নরসহ অন্তত ৬ জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পদত্যাগ করেন বলে খবর পাওয়া যায়। তবে গতকাল অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে ওই ৬ কর্মকর্তাকে কাজে যোগদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ২ জন ডেপুটি গভর্নর কাজে যোগদান না করার আভাস দিয়েছেন। আর ডেপুটি
গভর্নর কাজী সাইদুর রহমান বলেন, ‘আমি পদত্যাগ করিনি। সেদিন কিছু কর্মকর্তার উচ্ছৃঙ্খল এবং অপেশাদার আচরণে বিচলিত হয়ে পড়ি। একটা পর্যায়ে তাঁদের দেওয়া সাদা কাগজে স্বাক্ষর করি। কিন্তু এটা আমার ইচ্ছায় হয়নি। মূলত চাকরিতে আছি। হোম অফিস করছি।’

শুধু তা-ই নয়, কেপিআইভুক্ত এই প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তাবলয় ফাঁকি দিয়ে গত বৃহস্পতিবার অস্ত্রসহ ঢোকে ১৫-২০ জন বহিরাগত। এ সময় কামরুজ্জামান সাঈদী সোহাগ নামের এক যুবকের কাছ থেকে সেনাবাহিনীর সহায়তায় আগ্নেয়াস্ত্র (বন্দুক) জব্দ করে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এতে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

নিরাপত্তার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক লে. কর্নেল (অব.) মো. শামিমুর রহমান বলেন, ‘কামরুজ্জামান সাঈদী সোহাগ নামের এক যুবক অস্ত্রসহ অবৈধভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকে ঢোকার চেষ্টা করে। এটা কেপিআইভুক্ত প্রতিষ্ঠান। এখানে ভল্ট আছে। অস্ত্রের মুখে আমাদের ভল্ট খুলতে বাধ্য করতে পারে। তাই বৈধ অস্ত্র নিয়েও বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরে ঢোকার সুযোগ নেই। এখন থানা-পুলিশ থাকলে তাকে পুলিশের কাছে দেওয়া হতো। যেহেতু থানা সচল নেই, তাই তার অস্ত্র রেখে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৬ জন কর্মকর্তার পদত্যাগ আনুষ্ঠানিক ছিল না। শুধু ডেপুটি গভর্নর কাজী সাইদুর রহমান সাদা কাগজে স্বাক্ষর করে পদত্যাগ করেছেন। অন্যরা পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে অফিস থেকে চলে গেছেন। তাঁরা এখন অফিস করছেন না কেন, তা তাঁদের বিষয়।

এদিকে বেসরকারি সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংককেও (এসআইবিএল) এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে গতকাল মানববন্ধন করেছেন ব্যাংকটির শেয়ারধারীরা। তাঁরা অভিযোগ করেন, এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলম ও তাঁর সহযোগীরা আমানতকারীদের হাজার হাজার কোটি টাকা নামে-বেনামে তুলে পাচার করেছেন। ফলে আমানতকারীরা জমা করা অর্থ প্রয়োজন অনুযায়ী তুলতে পারছেন না।

একইভাবে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে বেসরকারি আইএফআইসি ব্যাংকেও। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান, তাঁর ছেলেসহ বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিনিধিত্বকারী সব পরিচালকের পদত্যাগ দাবি করেছেন ব্যাংকটির চাকরিচ্যুত কর্মকর্তারা। একই সঙ্গে সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শাহ এ সরোয়ারের সময় ‘অন্যায়ভাবে’ যাঁদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, তাঁদের পুনর্বহালের দাবি তোলা হয়েছে। গতকাল রাজধানীর পুরানা পল্টনে অবস্থিত ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে দুই শতাধিক লোক ‘আইএফআইসি ব্যাংকের চাকরিচ্যুত সকল কর্মকর্তাবৃন্দ’ ব্যানারে বিক্ষোভ করেন।

বেসরকারি খাতের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংককে (ইউসিবি) সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তাঁর পরিবারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার দাবিতে গত বৃহস্পতিবার আন্দোলন করেন ব্যাংকের শেয়ারধারীরা। ওই দিন সকালে গুলশানে ইউসিবির প্রধান কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন তাঁরা। এ সময় বিক্ষোভকারীরা বিভিন্ন ফেস্টুন প্রদর্শন করে সাবেক ভূমিমন্ত্রীর ‘বিদেশে অর্থ পাচার’ ও ব্যাংকটির নানা অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ উত্থাপন করেন।

এদিকে গত বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের এমডি আফজাল করিমকে অবরুদ্ধ করে রাখেন সুবিধাবঞ্চিতরা। পরে দাবি আদায়ে আশ্বাস দিলে তাঁকে চার ঘণ্টা পর উদ্ধার করা হয় বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শী ব্যাংক কর্মকর্তারা। পাশাপাশি সরকারি মালিকানাধীন জনতা ব্যাংকে বিক্ষোভ করেছে কর্মকর্তাদের একাংশ।

ব্যাংক খাতের এমন বিশৃঙ্খলা নিয়ে গবেষণা সংস্থা পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করছেন, পুরো ব্যাংক খাত একসঙ্গে সংস্কার করা যাবে না। কিছু কাজ করতে সময় লাগবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রশাসনিক কাঠামো দ্রুত পুনর্গঠন করতে হবে; পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংকের মালিকানা নিয়ে অরাজকতা বন্ধ করতে হবে। এ ছাড়া দ্রুত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হবে।

গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর খুঁজতে সার্চ কমিটি
গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ৯ আগস্ট পদত্যাগ করায় নেতৃত্বশূন্যতা চলছে বাংলাদেশ ব্যাংকে। ডেপুটি গভর্নররাও অফিসে আসছেন না। এমন পরিস্থিতিতে নতুন গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর খুঁজছে সরকার।

এ জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে গতকাল রোববার তিন সদস্যের একটি সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই সার্চ কমিটিতে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, সাবেক অর্থসচিব মুসলিম চৌধুরী ও সাবেক ডেপুটি গভর্নর নজরুল ইসলামকে রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে।

Share