বিরোধী মত দমানোয় অদেখা শক্তির উদ্ভবে গণঅভ্যুত্থান

নয়াবার্তা প্রতিবেদক : আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২০০৮ সালের নির্বাচনে সরকার গঠন করেছিল ‘ভূমিধস’ বিজয় নিয়ে। সংসদের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসনের এ সরকার দিন যত গেছে, ততই হয়ে উঠেছিল কর্তৃত্ববাদী। ক্ষমতার প্রশ্নে বিরোধী দল ও মত দমনের পাশাপাশি মহাজোটের দলগুলোকেও ধীরে ধীরে বশীভূত করে আওয়ামী লীগ। বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, হামলা, মিথ্যা মামলা, বিচার বিভাগকে ব্যবহারসহ নানা কৌশলে গত সাড়ে ১৫ বছরে বিরোধী দলগুলোকে দাঁড়াতেই দেয়নি আওয়ামী লীগ। দমনপীড়নে বিপর্যস্ত রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলনে বারবার ব্যর্থ হয়েছে। অরাজনৈতিক আন্দোলন একদিকে আওয়ামী লীগকে ভাবিয়েছে, অন্যদিকে এসব আন্দোলন মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থনও পেয়েছে।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর বলা হচ্ছে, কর্তৃত্ববাদী শাসনই কাল হয়েছে আওয়ামী লীগের। জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়েছে প্রথার বাইরের প্ল্যাটফর্ম থেকে। ক্ষোভ ও আন্দোলনের প্রচলিত মাধ্যম বিরোধী দলের বাইরের ‘অদেখা শক্তি’ থেকে উৎসারিত এ বিক্ষোভ তাই আর থামানো যায়নি।

গণতন্ত্রহীন পরিবেশে এমন ‘আনসিন ট্রিগার’ বা অদেখা শক্তির উদ্ভব হতে পারে বলে আওয়ামী লীগকে একাধিকবার সতর্ক করেছিলেন ঢাকায় বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের কূটনীতিকরা। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে পশ্চিমা একটি দেশের রাষ্ট্রদূত বলেন, কোনো দেশে যখন শক্তিশালী কোনো বিরোধী দল থাকে না বা রাষ্ট্রযন্ত্র যখন বিরোধী ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেয় অথবা বিরোধী মতকে দমন করে, তখন সমাজের ভেতর থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মতো ‘আনসিন ট্রিগার’ বা অদেখা শক্তির উদ্ভব হয়। গত ১০ বছর বাংলাদেশে হেফাজতে ইসলাম, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্যাট প্রত্যাহারে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের মতো একের পর এক এমন অদেখা শক্তির উদ্ভব হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ওই সময় আওয়ামী লীগকে সতর্ক থাকতে বলা হয়।

অদেখা শক্তির উদাহরণ দিতে গিয়ে এই কূটনীতিক বলেন, মনে করেন সাফ টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ বনাম নেপালের ফুটবল ম্যাচ। বাংলাদেশ দল নেপালের স্ট্রাইকার, গোলকিপার, মাঝমাঠ বা রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের আগের খেলা দেখে তাদের কৌশলের বিষয়ে একটা ধারণা পাবে। সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে পারবে। তবে যদি বাংলাদেশ দল মাঠে নামার পর দেখে প্রতিপক্ষ আর্জেন্টিনা! ভাবুন তো, বাংলাদেশ দলের অবস্থাটি কী হবে?

ঢাকায় বিভিন্ন দূতাবাসের একাধিক কূটনৈতিক সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে পশ্চিমা দূতাবাসগুলো তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারকে একাধিকবার বাংলাদেশ থেকে ‘রাজনীতি বিলুপ্ত’ করে দেওয়ার পরিণতি বিষয়ে সতর্ক করেছিল। দূতাবাসগুলো এ নিয়ে নিজেদের মধ্যেও আলোচনা করেছে। এমনকি এ-সংক্রান্ত ‘তারবার্তা’ নিজ নিজ দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও পাঠায়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কূটনীতিক বলেন, কোনো দেশে যখন বিরোধী দল রাজনীতিতে সক্রিয় থাকে বা থাকতে দেওয়া হয়, তখন জনগণের দাবি-দাওয়া বা আন্দোলন এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের সামনে আসে। এই দাবি-দাওয়া বা আন্দোলনগুলোর একটি নেতৃত্ব থাকে। সেখানে দরকষাকষির সুযোগ থাকে। ফলে ক্ষমতাসীনরা আলোচনার একটি জায়গা পায়।

বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় যত আনসিন ট্রিগার হয়েছে, তার কোনো কেন্দ্রীভূত নেতৃত্ব ছিল না। এ ছাড়া এ আন্দোলনগুলোর শক্তি সম্পর্কে আগে থেকে আঁচ করাও যায়নি। ফলে ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন সরকার শক্তি দিয়ে দমনের চেষ্টা করেছে। তবে যত শক্তি প্রয়োগ করেছে, আন্দোলন তত বড় হয়েছে। একসময় এ আন্দোলন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয় এবং সব শেষ এক দফায় পরিণত হয়। নেতৃত্ব না থাকায় কার সঙ্গে দরকষাকষি করা হবে বা আলোচনা করে সমাধান করা যাবে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য সরকারের কাছে ছিল না। এর পরিণতিই ভোগ করতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে।

বিশ্বের দেশগুলোর শাসন ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করা জার্মানিভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বেরটেলসম্যান স্টিফটুং, যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ২০১৪ সালের পর থেকে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবনতির কথা ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরেছে। নির্বাচনী ব্যবস্থা ও বহুদলীয় অবস্থান, নাগরিক অধিকার, সরকারের সক্রিয়তা এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণের দিক থেকে এখানে গণতন্ত্রের এমন অবনতি হয়েছে যে ‘গণতান্ত্রিক’ তো নয়ই, ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক’ দেশের তালিকায়ও বাংলাদেশের নাম ছিল না। গত এক দশকে স্বৈরতান্ত্রিক ও ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক অবস্থার মাঝামাঝি ‘হাইব্রিড রেজিম’ তালিকায় অবস্থান করেছে বাংলাদেশ। আর বেরটেলসম্যান স্টিফটুং তো বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থাকে স্বৈরশাসন আখ্যায়িত করেছে।

সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার এত আত্মবিশ্বাসী ছিল, কারও কথা না শুনলেও কিছু হবে না বলে তাদের ধারণা ছিল। কোনো ঘটনার পাল্টা প্রতিক্রিয়া তারা হতে দেয়নি। ২০০৯ সালে যখন তারা ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল, তখন বৈশ্বিকভাবে সবার সন্ত্রাসবিরোধী একটি অবস্থান ছিল। বিরোধী দল আন্দোলন করতে গেলে আওয়ামী লীগ সেই আলোকে তাদের দেখিয়েছে। আর আড়ালে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে গেছে।

তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ মনে করেছিল, সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থানে আন্তর্জাতিক সমর্থন অব্যাহত থাকবে। তবে এই কার্যক্রমে দু-একজন বন্ধুর সমর্থন পেলেও ২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচন করে পার পেয়ে যাওয়ার পর দমনের যে ধারা শুরু হয়, তা আর থামেনি। গুম, খুন, বিরোধী মত দমনসহ প্রায় সব ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে। অভ্যন্তরীণভাবে বিরোধী শক্তিগুলোর জনসম্পৃক্ততা কম থাকার সুযোগও নিয়েছে দলটি। এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ সরকার সর্বগ্রাসীতে পরিণত হয়। এ ছাড়া উন্নয়নের একটি আখ্যান দাঁড় করিয়েছিল তারা। কেউ যদি এর বিপক্ষে কথা বলত, তাকেই সন্ত্রাসীর তকমা দিয়ে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করা হতো। সব মিলিয়ে কারও উদ্বেগ পাত্তা দেওয়া হয়নি। বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিও যখন তেমনভাবে সফল হচ্ছিল না, তখন আপাত নিরীহ আন্দোলন গণমানুষের আন্দোলনে রূপ নেয়।

Share