নয়াবার্তা প্রতিবেদক : স্বাধীন নিরপেক্ষ ও স্বশাসিত সংস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন ‘দুদক’ দেশে দুর্নীতি দমন, নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে কাজ করে। নখ দন্তহীন এই সংস্থা ক্ষমতার পালাবদলে হঠাৎ সিংহের গর্জনে সরব হয়ে উঠেছে। সদ্য ক্ষমতাচ্যুত সরকারের প্রধানমন্ত্রী, হোমড়া চোমড়া মন্ত্রী এবং বহুল আলোচিত কতিপয় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীর দুর্নীতি তদন্তে পৃথক একটি স্পেশাল টাক্সফোর্সসহ মোট ৯টি বিশেষ টাক্সফোর্স গঠন করেছে।
দুদক সূত্র জানিয়েছে, সদ্য ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বেক্সিমকো গ্রুপ এবং তার মালিক সালমান এফ রহমান, সামিট গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ ও নাসা গ্রুপ এবং বেশ কয়েকজন আলোচিত মন্ত্রী ও রাজনীতিকের দুর্নীতির তদন্ত করবে ১নং টাক্সফোর্স। অন্য ৮টি টাক্সফোর্স সারাদেশের আলোচিত দুর্নীতিবাজদে দুর্নীতি তদন্ত করবে।
সূত্র জানায়, ইতিমধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসামরিক, শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা ও বেক্সিমকো গ্রুপের চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান, সাবেক পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু এবং সাবেক সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
জানা গেছে, শেয়ার বাজারে জালিয়াতি, প্লেসমেন্ট শেয়ার কারসাজি ও প্রতারণার মাধ্যমে শেয়ার হোল্ডারদের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট, অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংক হতে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণপূর্বক আত্মসাৎসহ হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে।
সাবেক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। তিনি মন্ত্রী থাকাকালে নিজ মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রণালয়ের অধীন অভিদপ্তরের কর্মকর্তাদের বদলি বাণিজ্যে, বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে ১ হাজার ৫০২ কোটি টাকার ‘সুফল প্রকল্পে’ অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন।
এদিকে জুনাইদ আহমেদ পলকের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ গ্রহণ, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাৎসহ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।
অন্যদিকে নসরুল হামিদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাৎসহ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ।
এছাড়া নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, সাবেক সংসদ সদস্য, ভোলা-৩ নানাবিধ অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
নানা অভিযোগের কারণে এ পাঁচজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি।
উল্লেখ্য, নামে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা হলেও এই সংস্থাটির বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। জনগুরুত্ব মামলা রেখে সরকারের দুর্নীতিবাজদের ‘ক্লিনশিট’ দেওয়ায় ব্যস্ত থাকার অভিযোগ পুরোনো। স্বশাসিত সংস্থা হলেও সরকার নাখোশ হয়-এমন মামলায় তদন্ত করতে এতদিন অনিচ্ছুক ছিল তারা। তবে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই সরব হয়ে উঠেছে দুদক। গত এক সপ্তাহে সরকারের প্রভাবশালী অন্তত ৫০ জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মামলাও হয়েছে ডজনের বেশি। তবে দুদকের কর্মকর্তারাই বলছেন, কমিশন নিজেদের দায় এড়াতে তড়িঘড়ি করে অভিযোগপূর্ণ তদন্ত না করে আংশিক প্রতিবেদন দিয়েই মামলা করে দিচ্ছে। এর ফলে অপরাধীদের খালাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
দুদকের তথ্যমতে, সরকারের পতনের পর থেকেই সাবেক মন্ত্রী-এমপি, রাজনৈতিক নেতা, প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা, ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে জোরেশোরে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। তাদের অনুসন্ধানের তালিকায় রয়েছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আছাদুজ্জামান, প্রভাবশালী শ্রমিক নেতা আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান। মাদারীপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক চিফ হুইফ নূরে আলম চৌধুরী, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, সাবেক ত্রাণ ও দুযোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম, তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, নৌপ্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, ধর্মমন্ত্রী ফরিদুল হক, সাবেক পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন, শিল্পপ্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিবুর রহমান।
তালিকায় আরও রয়েছেন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা ও জয়পুরহাট-২ আসনের সাবেক এমপি আবু সাইদ আল মাহমুদ স্বপন, বাগেরহাট-১ আসনের সাবেক এমপি শেখ হেলাল উদ্দিনসহ অন্তত এক ডজন আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি। গত ১৫ বছরে এসব মন্ত্রী-এমপির আয় বেড়েছে গড়ে কয়েক হাজার গুণ। কারও ক্ষেত্রে সম্পদ ও আয় বেড়েছে লাখ গুণ পর্যন্ত।
এ ছাড়া তদন্ত শুরু হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক উপপ্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব শাহ কামাল, ঢাকা ওয়াসার সাবেক এমডি তাকসিম এ খানসহ আরও কয়েকজন প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। দুদক সূত্রে জানা গেছে, এসব কর্মকর্তার মধ্যে সাবেক সিনিয়র সচিব শাহ কামালের বিরুদ্ধে এর আগেও দুদকে অভিযোগ জমা পড়েছিল। ২০২০ সালে শাহ কামালকে দায়মুক্তি দেয় দুদক। শাজাহান খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়ায় ২০১৪ সালে তাকে দুদকে তলব করা হয়েছিল। এ ছাড়া ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খানের বিরুদ্ধেও এর আগে দুদকে অভিযোগ জমা পড়েছিল। তবে সে সময় প্রভাবশালী এই কর্মকর্তাদের দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে তদন্ত হয়নি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীরা তাদের হলফনামায় যে সম্পদের বিবরণ পেশ করেছিলেন, সেখানে আয়ের উৎসবহির্ভূত সম্পদ বেড়েছে, এমন অন্তত দেড়শ এমপি-মন্ত্রীর নাম আলোচনায় আসে। তবে নির্বাচনের আগে প্রার্থীদের ‘ইমেজের’ কথা চিন্তা করে বিষয়টি সামনে আনতে চাননি দুদক চেয়ারম্যান। নির্বাচনের পরও ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো একাধিক প্রভাবশালী এমপি দুর্নীতি করেননি জানিয়ে ‘ক্লিন সার্টিফিকেট’ দেওয়া হয়।
এমন প্রেক্ষাপটে দুদকের মধ্যেই কর্মকর্তারা বলছেন ভিন্ন কথা।তাদের মতে, ‘এই কমিশন দুর্নীতি প্রতিরোধে পুরোপুরি ব্যর্থ। এখন তারা দায় এড়াতে তড়িঘড়ি করে পুরোনো অভিযোগ নিয়ে কাজ শুরু করেছে। এসব অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে কমিশনে জমা পড়েছিল। এতদিন তারা এসব অভিযোগ নিয়ে কাজ করেনি। ফলে দুর্নীতিবাজরা ধীরে ধীরে হয়েছে আরও লাগামহীন।’
দুদক সূত্র বলছে, ‘দুদকের কাজ তপশিলভুক্ত অভিযোগ নিয়ে জনগুরুত্ব বিবেচনায় কাজ করা। কিন্তু তারা সেটি না করে সরকারের আদেশ-নির্দেশনামতো কাজ করেছে। এখন তারা নিজেদের চেয়ার বাঁচাতে তড়িঘড়ি করে বিভিন্ন পুরোনো ফাইল খুলছে। এর মাধ্যমে কমিশন মূলত নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ করতে চাচ্ছে। কমিশন এখনো ফাইল চালু করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তারা কোথাও অভিযান চালাচ্ছে না, কোথাও যাচ্ছে না। মাঠ কর্মকর্তাদের তদন্তের বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দিচ্ছে না। এ ছাড়া তাড়াহুড়ো করে কাজ করায় অনেক মামলা পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করা হচ্ছে না, সময় দেওয়া হচ্ছে না। কিছু একটা পেলেই মামলা করে দিচ্ছে। ফলে এসব মামলায় আসামিদের খালাস পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।’