জাতীয় সংগীত ও সংবিধান পরিবর্তন চান আমান আযমী

নয়াবার্তা প্রতিবেদক :  জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের ছেলে আব্দুল্লাহিল আমান আযমী বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতকে ‘স্বাধীনতার অস্তিত্বের পরিপন্থি’ আখ্যা দিয়ে তা পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছেন। তিনি আট বছর ‘গুম থাকার’ সময়ের বর্ণনা দেওয়ার পাশাপাশি নতুন করে সংবিধান রচনার দাবি জানিয়েছেন। সেনাবাহিনীর সাবেক এই ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বাহাত্তরের সংবিধান ‘বৈধ নয়’ মন্তব্য করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করারও দাবি জানিয়েছেন।

মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়েও। আট বছর ‘গুম করে রেখে’ তার উপর চালানো নির্যাতনেরও বর্ণনা দিয়েছেন তিনি।

আমান আযমী বলেন, “১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গ-রদ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। এই জাতীয় সংগীত দুই বাংলা এক করার জন্য জাতীয় সংগীত। আমরা কি দুই বাংলা এক হতে চাচ্ছি? আমরা কি স্বাধীন বাংলাদেশ রাখতে চাই, নাকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অঙ্গীভূত রাজ্য হতে চাই?

“আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ চেয়েছি, স্বাধীন বাংলাদেশ থাকতে চাই। এই জাতীয় সংগীত আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের পরিপন্থি। আমি জোর দাবি জানাচ্ছি আমাদের নতুন জাতীয় সংগীত তৈরি করা হোক।”

বাহাত্তরের সংবিধানকে ‘অবৈধ’ আখ্যা দিয়ে সাবেক এ সেনা কর্মকর্তা বলেন, “১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগ জনগণের কাছ থেকে ম্যান্ডেড নিয়েছিল পাকিস্তানের সংবিধানের অধীনেই পাকিস্তান রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য, স্বাধীন সংবিধান রচনা করে নয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান আমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে, আমরা যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছি- আলহামদুলিল্লাহ।

“কিন্তু তারা জনগণের কাছ থেকে নতুন সংবিধান প্রণয়ণের কোনো ম্যান্ডেড নেয়নি। সুতরাং এই সংবিধান আমার দৃষ্টিতে বৈধ নয়। নতুন করে একটা কমিটি করে নতুন সংবিধান তৈরি করা হোক, এটা বাতিল করা হোক।”

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার থাকা অবস্থায় ২০০৯ সালে বরখাস্ত হন আমান আযমী। ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের তথ্যকে ‘কাল্পনিক’ বলে তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচিত হয়েছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে আবারও একই প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, “শেখ মুজিব সাহেব ৩ লাখ বলতে গিয়ে ৩ মিলিয়ন বলেছেন এবং এটাই ৩০ লাখ হয়ে গেছে। কোনো জরিপ ছাড়া ৩০ লাখ শহীদ বলে বলে তারা মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।

“আমি সরকারের কাছে আবেদন জানাই, আপনারা জরিপ করে বের করেন, একচুয়ালি ৩০ লাখ হোক আর ৩ কোটি হোক। আমার জানামতে, এটা ২ লাখ ৮৬ হাজার। তারা ৩ লাখকে ৩০ লাখ বানিয়ে ফেলেছে। এখনো সময় আছে, জাতিকে সত্য ইতিহাস জানতে দিন। আমাদের নতুন প্রজন্মকে মিথ্যার উপরে আপনারা গড়ে তুলতে দেবেন না। সত্যিকার একটা জরিপ করে আপনারা ব্যবস্থা করেন।”

আবদুল্লাহিল আমান আযমী বলেন, ২০১৬ সালের ২২ অগাস্ট তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পরের বছরগুলোতে আটকে রেখে চালানো হয় নির্যাতন।

“দুটি কারণে আমাকে তারা গুম করে রেখেছিল। আমার পৈত্রিক পরিচয় এবং আমি ভারতবিরোধী। আমি আমার মায়ের সঙ্গে খেতে বসেছিলাম, এ সময় সরকারের গুণ্ডাবাহিনী- আমি গুণ্ডাবাহিনী বলছি এজন্য যে মামলা ছাড়া, ওয়ারেন্ট ছাড়া উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হল গুণ্ডাদের কাজ। এই কাজ যেই করেছে তারা সরকারের গুণ্ডাবাহিনী।

“তারা আমার বাসায় আসে। তাদের মাঝে যাকে আমার অফিসার বলে মনে হয়েছে, আমি ৩০ বছর একটা বাহিনীতে চাকরি করেছি। আমি পোশাক দেখলে বলতে পারি, কে অফিসার আর কে কোন পদবীর কর্মকর্তা। যাকে আমার অফিসার বলে মনে হয়েছে- সে আমার সাথে অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করেছে। আমাকে তুই করে কথা বলেছে। চরম দুর্ব্যবহার করেছে।

“আমি তাদের কাছে জানতে চেয়েছি, আপনারা কারা- আপনাদের পরিচয় কি? তারা আমার কোনো কথার জবাব দেয়নি। তাদের বলেছি- মামলা বা ওয়ারেন্ট ছাড়া আমায় গ্রেপ্তার করতে পারেন না। এরপর তারা চোখ বেঁধে একটি মাইক্রোবাসে ওঠায়। তারপর একটি মুখোশ পরায়।”

ঘণ্টা দুয়েক পর একটি কক্ষে নিয়ে চোখ খুলে দেওয়া হয় জানিয়ে আমান আযমী বলেন, “রুমে নিয়ে গিয়ে আমাকে চোখ, হাত খুলে দিল। তারা আমাকে বিরিয়ানি খেতে দিল, তখন কি বিরিয়ানি খাওয়ার মত মানসিকতা থাকে? আমি তো তখন মৃত্যুর আশংকা করছি। আমি গাড়িতে তাদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনারা কি আমাকে ক্রসফায়ারের জন্য নিয়ে যাচ্ছেন? তারা বলেছিল- না, আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আপনার সঙ্গে কথা বলবে। কথা বলা শেষ হলে আপনাকে দিয়ে যাব আমরা।”

মৃত্যুর আতঙ্কে ঘুমাতে পারেননি জানিয়ে আমান আযমী বলেন, “আমাকে যে ঘরে রাখা হয়েছিলো, সেখান থেকে টয়লেটের দূরত্ব ছিল ৫০ কদম। কিন্তু সেখানে নিয়ে যাওয়ার সময়ও দু’হাত বেঁধে, চোখ বেঁধে, মুখোশ পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হতে। টয়লেটের ভেতরে গিয়ে চোখ-হাত খুলে দিত। বাইরে থেকে স্টিলের দরজা বন্ধ করে তালা মেরে রাখত। কাজ শেষ হলে তারা আবার দরজা খুলে দিত। তারপর চোখ-হাত বেঁধে নিয়ে আবার রুমে নিয়ে আসত।

“সারারাত পায়ের আওয়াজ শুনলেই মনে হত আমাকে বুঝি তারা ক্রসফায়ারে নিয়ে যাচ্ছে। আমি তাহাজ্জুদ পড়ে দোয়া করেছি, আল্লাহ এ নামাজ যদি আমার শেষ নামাজ হয়। জালেমদের হাতে যদি আমার মৃত্যু হয়, আমাকে শহীদের মর্যাদা দিও। আর আমার লাশ যেন কুকুর-বিড়াল না খায়। আমার লাশ আমার সন্তানদের কাছে পৌঁছে দিও।

“আগের দিন দুপুরে খেয়েছি, সারারাত ঘুম নাই, খাওয়া নাই- মৃত্যুর আতঙ্ক। পরদিন সকালে আমাকে নাশতা দিয়েছিল চা-পরোটা আর ডিমভাজি। নাশতা দেখেই আমার চোখ দিয়ে পানি এল, কারণ আমি মায়ের সঙ্গে খেতে বসেছিলাম। তাদের বললাম, আমি খাব না। পরে ১২টার দিকে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। পরে দেখি আমার হাতে স্যালাইন দেওয়া।”

আট বছর পৃথিবীর আলো দেখেননি জানিয়ে আযমী বলেন, “আমি গেল আট বছর সেখানে বন্দি থাকা অবস্থায় আকাশ দেখিনি, সূর্য দেখিনি। মাঝে মাঝে তারা চোখ এমনভাবে বাঁধতো, মনে হত আমার চোখের মনি ফেটে যাবে। হাতকড়া পরা থাকতে থাকতে হাতে ঘা হয়ে যেত। আট বছর আমি এক অন্ধকার ঘরে ছিলাম, পৃথিবীর কিছুই আমি দেখতে পাইনি এ সময়।”

গত ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের দুই দিন পর বাড়ি ফিরেন আমান আযমী। তিনি বলেন, “ফিরে এসে আমি জানতে পেরেছি, তারা আমার স্ত্রীর সাথেও চরম দুর্ব্যবহার করেছে। তাকেও তারা উঠিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। আমার বাসার যুবতী কাজের মেয়ে, তার গায়েও তারা হাত উঠিয়েছে। আমার বাসায় যে আমাদের দেখাশুনা করে, আমাদের ম্যানেজার- তাকে ফেলে তার বুকের ওপর লাফিয়েছে।

“আমাদের যে দারোয়ান ছিল, তাদের ওপর নির্যাতন করেছে। আমাদের বাসা তছনছ করে দিয়েছে। বাসার পাশের সড়কে যে সিসি ক্যামেরা ছিল, সেগুলোও তারা ভেঙেছে। আশেপাশে যে বাসায় সিসি ক্যামেরা ছিল, সেই বাসায় গিয়ে তারা রেকর্ডার নিয়ে গেছে। সমস্ত এলাকা ত্রাসের সৃষ্টি করে তারা আমাকে নিয়ে চলে গেল।”

‘নির্মম জীবন’ থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের প্রতি ধন্যবাদ জানান আব্দুল্লাহিল আমান আযমী।

Share