নয়াবার্তা প্রতিবেদক : অর্থঋণ আদালতে বিচারাধীন মামলার মাধ্যমে অবলোপনকৃত এবং খেলাপি ঋণে আটকে যাওয়া মোট ৪ লাখ ৪৭ হাজার ৮৮০ কোটি টাকার অনাদায়ী ঋণেরভারে দেশের ব্যাংকখাত নিঃশেষ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আইন বিভাগের প্রণীত অর্থঋণ আদালতে বিচারাধীন মামলার প্রতিবেদনে এবং বর্তমান খেলাপি ঋণের সর্বশেষ তথ্য বিশ্লেষণে এই তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আইন বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারাদেশের অর্থঋণ আদালতে বিচারাধীন ৬০টি ব্যাংকের ২ লাখ ৭ হাজার ৫৯৩টি মামলায় অনাদায়ী ঋণের ২ লাখ ৩৬ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা আটকা রয়েছে। আটকে থাকা এই ঋণের অর্থ ব্যাংকগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন থেকে বাদ দিয়ে অবলোপন করা হয়েছে। ঋণ অবলোপন হলো খেলাপি হয়ে যাওয়া কোনো ঋণকে ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন থেকে বাদ দেয়ার সুযোগ। অবলোপনকৃত ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন বা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আইন বিভাগের প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত মামলার সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৬ হাজার ৫৮৪টি। এর বিপরীতে জড়িত অর্থের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ২৬ হাজার ২৯২ কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত মামলার সংখ্যা বেড়েছে ১ হাজার ৯টি। আর জড়িত অর্থের পরিমাণ বেড়েছে ১০ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা।
উল্লেখ্য, বর্তমানে দুই বছর মন্দ মানের শ্রেণীকৃত যেকোনো ঋণই অবলোপন করা হয়। আগে তিন বছর মন্দ মানের খেলাপি থাকার পর তবেই ওই ঋণ অবলোপন করার সুযোগ ছিল। তবে অবলোপনের পূর্বে অবশ্যই এসব অনাদায়ী ঋণের বিরুদ্ধে অর্থ ঋণ আদালত আইন, ২০০৩ অনুযায়ী অর্থ ঋন আদালতে মামলা করতে হয়।
অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের জুন শেষে দেশে বর্তমানে মোট ঋণের পরিমাণ ১৬ লাখ ৮৩ হাজার ৩৯৬ কোটি। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। ৩ মাস আগে মার্চ শেষে এই ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। আর ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। ৩ মাসের ব্যবধানে মার্চ শেষে খেলাপি বেড়েছিলো ৬৫ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা বা ৪৫ দশমিক ১৫ শতাংশ। অথচ পরবর্তী ৩ মাসের ব্যবধানে দেশে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা বা ১৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ।
পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত জুন শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ১২ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ লাখ ২ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকাই খেলাপি। যা বিতরণকৃত ঋণের ৩২ দশমিক ৭৭ শতাংশ। আর বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৯ হাজার ৯২১ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ। রাষ্ট্রের বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা। যা বিতরণকৃত ঋণের ১৩ দশমিক ১১ শতাংশ। এ ছাড়া বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২২৯ কোটি টাকা বা বিতরণকৃত ঋণের ৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ। গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। এর মানে বছরের প্রথম তিন মাসে বেড়েছিল ৩৬ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা। জুন শেষে দেশের তফসিলি ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। জুন শেষে ব্যাংকগুলোর মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৮৩ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। এর মানে মোট ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ খেলাপি।
খাত সংশ্লিষ্ট ব্যাংকাররা বলছেন, বিগত সরকারের আমলে সুশাসনের অভাব ও খেলাপি ঋণই বর্তমান ব্যাংকিং খাতের বড় সমস্যা ছিল। ব্যাংক খাতে সুশাসন না থাকার কারণে দিন দিন খেলাপি বেড়েছে। এ সমস্যা মোকাবিলায় ঢালাওভাবে ছাড় দিয়েও নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। পাশাপাশি খেলাপি ঋণের তথ্য গোপনেরও একটি প্রচেষ্টা ছিল। সবমিলিয়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খেলাপি তথ্য গোপন না করায় হঠাৎ এই সূচকে বড় লাফ দিয়েছে।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋন এবং অর্থঋণ আদালতে বিচারাধীন মামলায় অবলোপনকৃত ঋণের কারণে ব্যাংকগুলো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছেনা। তিনি আশাবাদ ব্যাক্ত করেন যে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অচিরেই ব্যাংক খাতে এই অবস্থার উন্নতি হবে।