নয়াবার্তা প্রতিবেদক : ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে যান শেখ হাসিনা। কোটা সংস্কার আন্দোলনে থেকে শুরু করে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্ল্যাটফর্ম।
আন্দোলন চলাকালীন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ও গোয়েন্দা শাখার প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের সঙ্গে তাদের বাগবিতণ্ডা হয়। বাগবিতণ্ডার পর রোমহর্ষক নির্যাতন চালানো হয়। সেই রোমহর্ষক নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার।
সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) সকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক পোস্টে ডিবি হারুনের লোমহর্শক নির্যাতনের বর্ণনা দেন আবু বাকের।
ফেসবুকে স্ট্যাটাস তিনি লেখেন, ডিবি হারুন আমাকে জিজ্ঞেস করে ‘তুই ফ্রন্টলাইনে আসিস না কেন? তুই কি মনে করিস তোরে আমরা চিনি না? তুই কোথায় কি করিস সব তথ্য আছে ‘ আমি চুপ থাকি, পরে আবার ‘কথা বলিস না কেন?’ আমি বলি, ‘আমি ব্যাকস্টেজে কাজ করতে পছন্দ করি।’ আবার বলে, ‘১৫ তারিখ একাত্তর হলে যখন মারামারি হয় তখন তুই কই ছিলি?’ আমি বলি, একাত্তর হলের সামনেই।।। সে বলে, তুই ত প্রথম মারামারি লাগাইছস, মারামারিতে নেতৃত্ব দিছস! আমি বলি, ‘ছাত্রলীগ আমাদের মারে, পরে আমরা প্রতিরোধ করি ‘ এভাবে অনেক প্রশ্ন উত্তর হয় ১৫ই জুলাই নিয়ে।
হারুনের সাথে বাকবিতন্ডায় জড়ানোর পরঃ
হারুনের যেই ভাতের হোটেল চিনেন, সেই হোটেলে হারুন খাচ্ছিলো। ডিবি হেফাজতের দ্বিতীয় দিন আমাকে, নাহিদ ভাইকে, আসিফ ভাইকে তার সামনে নিয়ে যাওয়া হয়। হারুনের ব্যবহার ছিলো অত্যন্ত বাজে এবং হল ছাত্রলীগের উপসম্পাদক ক্যাটাগরির। আমাদেরকে বলতেছিলো, আমি নেতা ছোট করি, নেতা বানাই না! দেখোস নাই, নূরুরে কি করে ছেড়ে দিছি! নূরু এখন রিমান্ডে কান্নাকাটি করে।
সে যেভাবেই কথা বলুক না কেনো, আমরা তিনজন খুব দৃঢ় ভাবে কথা বলে যাচ্ছিলাম। এক পর্যায়ে সে আমাকে বলে, ‘তুই শিবির’! আমি বলি, ‘না আমি শিবির না’! সে আবারো (একটু উচ্চ শব্দে) বলে, ‘না, তুই শিবির’। আমি আবারো বলি ‘না (ওর থেকে উচ্চ শব্দে ‘। সে আসিফ ভাই, নাহিদ ভাইকে দেখিয়ে দিয়ে বলে, ‘দেখ, সে কিভাবে কথা বলে ‘
ওর কথা বলার মঝেই ওর থেকে উচ্চ শব্দে বলতে থাকি, ‘আমার পুরো বাড়ির মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, আমার বাড়িতে যোদ্ধারা ক্যাম্প করেছিলো, আমি সেই বৃহত্তর পরিবারের সন্তান’।
আমি তার থেকে উচ্চবাচ্য করায় সে প্লেট ছুড়ে ফেলে দিয়ে এক অফিসারকে ইশারা দিয়ে বলে আমাদেরকে নিয়ে যেতে। আমাদের তিনজনকে তিনটি আলাদা রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। রুমে যাওয়ার ৩/৪ মিনিট পর দুইজন লোক এসে আমাকে দরজায় আসতে বলে, তাদের হাতে ছিলো জম টুপি (কালো বড় টুপি, গলা পর্যন্ত ঢেকে যায়) এবং হাতকড়া। বুঝে গেছিলাম, হারুনের সাথে পার্সোনালিটি দেখানোর জন্য খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে। দরজায় আসার সাথে সাথেই টুপিটি পরায়, তারপর হাতকড়া পরায়। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো, দুনিয়ার আলো কিছুই দেখা যায় না, ভয়ংকর একটা পরিবেশ। ডানে, বামে ঘুরিয়ে হাঁটানো শুরু করলো, বারবার মনে হচ্ছিলো ছাদের পাশে নিয়ে এই অবস্থায় ফেলে দেয় কিনা! আর জিজ্ঞেস করতেছিলাম, ‘নাহিদ ভাই, আসিফ ভাইকেও নিচ্ছে কিনা ‘, তারা জানালেন, তারা এ বিষয়ে জানে না, উনাদের দায়িত্ব শুধু আমাকে নিয়ে যাওয়া। নাহিদ ভাই, আসিফ ভাই অনেক অসুস্থ ছিলেন, উনাদের জন্য ভয় হচ্ছিলো।
যাই হোক, তারপর লিফটে, আবার হেঁটে, আবার সিড়িতে,,,এভাবে কোনো একটা রুমে নিয়ে গেলো। একটা জিনিস বারবার মাথায় আসছিলো যে আমাকে মেরে ফেলে কিনা, ফ্যাসিস্ট সরকারের কাছে ত বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড সাধারণ ঘটনা ছিলো। তারপর রুমে নিয়ে দেয়ালের দিকে ঘুরিয়ে জম টুপি খুলে গামছা দিয়ে খুব শক্ত করে চোখ বাধলো, আর হাতগুলোও বড় গামছা দিয়ে বাধলো। হাত বাধার সময় এমন ভাবে বাধলো যেনো হাতের বেশি জায়গা জুড়ে গামছা থাকে। তারপর উলটা ঘুরতে বলে, একপায়ে দাঁড়াতে বলে। টানা ৭২ ঘন্টা না ঘুমানোর জন্য শরীরে ব্যালেন্স ছিলো না। দাড়ানোর চেষ্টা করেও বারবার ব্যার্থ হই। শেষে সোজা হয়েই দাড়াতে বলে এবং জিজ্ঞাবাদ শুরু করে।
ওদের কথায় বুঝতে পারছিলাম যে, ওরা মোটামুটি আমাদের সবকিছু জানে। আমাকে শুরুতেই বলে, ‘তুই ত জুনের ৯ তারিখ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত সারাদেশকে সংগঠিত করতে লিড দিছোস, তোর ত আন্দোলনকে বড় করার অনেক খায়েশ! তোরে এগুলো কে শিখাইছে? তোর ত বয়স বেশি না! ট্রেনিং পাইছোস কই ‘
উত্তরে আমি বলি, ‘আমি ছাত্রসংগঠন করি, গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্য সচিব, সংগঠন শুরুতে দাড় করানোর জন্য এবং পরবর্তীতে বিস্তারের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আমি মানুষকে সংগঠিত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছিলাম, সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছ‘ তারপর কিছুক্ষণ প্যাচায়!
তারপর আবার, ‘তুই ফ্রন্টলাইনে আসিস না কেন? তুই কি মনে করিস তোরে আমরা চিনি না? তুই কোথায় কি করিস সব তথ্য আছ ‘ আমি চুপ থাকি, পরে আবার ‘কথা বলিস না কেন?’ আমি বলি, ‘আমি ব্যাকস্টেজে কাজ করতে পছন্দ করি।’ আবার বলে, ‘১৫ তারিখ একাত্তর হলে যখন মারামারি হয় তখন তুই কই ছিলি?’ আমি বলি, একাত্তর হলের সামনেই।।। সে বলে, তুই ত প্রথম মারামারি লাগাইছস, মারামারিতে নেতৃত্ব দিছস! আমি বলি, ‘ছাত্রলীগ আমাদের মারে, পরে আমরা প্রতিরোধ কর ‘ এভাবে অনেক প্রশ্ন উত্তর হয় ১৫ই জুলাই নিয়ে। তারপর জিজ্ঞেস করে, ‘তোর গুরু কে?’ উত্তর দেই আমার কোনো গুরু নাই, শুধুমাত্র জাতীয় স্বার্থে সংগঠন করি, আর আন্দোলনও ঠিক একই কারণে করে যাচ্ছি। এই বিষয়েও আরো অনেক সাবস্টিটিউট প্রশ্ন উত্তর হয়।
তারপর আবার, ‘তুই কি সরকারি চাকরি করবি?’
আমি বলি করতেও পারি, তবে আমার রাজনীতি ও একাডেমি নিয়ে আগ্রহ আছে। এটা নিয়ে অনেক প্যাচানোর চেষ্টা করে। এরকম আরো অসংখ্য প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে (বেঁচে থাকলে সব লিখবো), সর্বশেষ বলে, সরকার ত কোটা নিয়ে সব দাবিদাওয়া মেনে নিয়েছে তারপরও এখন কিসের আন্দোলন? আমি চুপ থাকি, ওরা চিল্লাপাল্লা করে, ঝাড়া ঝাড়ি করে, তখনো চুপ থাকি। একজন বলে উঠে, ওরে ঝুলা। আমি তখনো চুপ থাকি। তারপর পাশের রুমে নিয়ে যাওয়া হয়, নিয়ে হাত উপরে ঝুলিয়ে বাধা হয়। আমি বলি পিঠে মারলে মরে যাবো, বাম পায়ে একটু সমস্যা আছে, বাম পা টা ভেঙে যাবে। ওরা কিছু বলে না। একপর্যায়ে নিতম্বে মোটা শক্ত কোনো লাঠি দিয়ে একের পর এক আঘাত করে, আর আমি চিল্লানো দিয়ে উঠি, আর ওরা বলে, প্রাইমিনিস্টারকে ধন্যবাদ দিয়ে বিবৃতি দিবি? আমি বলি, ❝না❞। এরকমভাবেই চলতে থাকে।
স্কুল লাইফে টিচারদের অনেক মাইর খেয়েছিলাম, স্যাররা বেত ব্যবহার করতেন, মারার সময় নার্ভ সিস্টেম অটোমেটিক একটা প্রটেক্টিভ ভূমিকায় চলে যেতো, অন্তত ম্যান্টাল প্রিপারেশন থাকতো। কিন্তু এখানে তা নাই, চোখ বন্ধ, হাত বাঁধা, যেন হুট করে লাঠির আঘাত লাগছে। খুব ভয়ংকর লাগছিলো এবং ব্যথা তূলনামূলক বেশি পাচ্ছিলাম। আমি পানি চাই, বোতলের চিপি (ছিপি) করে এক চিপি (মুখ) পরিমাণ পানি দিয়েছিলো। জিহবা-গলা শুকিয়ে যেনো কাঠ হয়ে গিয়েছিলো। বেধড়ক মারার পর এক পর্যায়ে সামনে থেকে কেউ একজন বলে, ওরে রেস্ট দে। বড় নিঃশ্বাস নিলাম। আর ভাবতেছিলাম, যতো ভয় পাইছি যে সহ্য করতে পারবো কিনা,ততো না! আসলে বেঁধে পেটালে কার না সহ্য হয়! যাইহোক তারপর দ্বিতীয় দফায় মার খাওয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। উপরে হাত ঝুলানো হলেও পায়ের আঙুল ফ্লোরে লাগিয়ে একটুখানি ভর দেয়া যাচ্ছিলো। প্রথম দফা মারার পর আমাকে প্রায় এক ঘন্টা বা তারও বেশি এভাবে ঝুলিয়ে রেখেছিলো। আর আমি পানি চাইলে বোতলের মুখে (চিপিতে) এক মুখ পানি দিতো। এভাবেই যাচ্ছিলো, আর মনে মনে সেকেন্ড রাউন্ডের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আর ভাবতেছিলাম, নাহিদ ভাই আর আসিফ ভাইয়ের যেনো কি অবস্থা! ওই সময়ে আমি তূলনামূলক উনাদের থেকে স্ট্রং ছিলাম।
যাই হোক, এক পর্যায়ে আমার অনেক প্রস্রাবের বেগ হলে তাদেরকে জানালে ওয়াশরুমে নিয়ে যায়। ওয়াশরুম থেকে বের হওয়ার পর আমাকে আর ঝুলায়নি, এবার একটা চেয়ারে বসতে দেয়। হাত চোখ বাধা অবস্থায় পড়ে থাকি, আর সেকেন্ড রাউন্ডের অপেক্ষা করি। সেকেন্ড রাউন্ড কখন শুরু হবে, জিগ্যেস করলে সামনে থাকা ব্যক্তি বলেন, তিনি জানেন না, তার স্যার উপস্থিত নাই।
নরমালি ঝুলানো অবস্থা থেকে বসালে ব্যাথা আরো বেড়ে যায়, ঝুলানো থেকে খোলার পর হাঁটতে অনেক কষ্ট হচ্ছিলো। এভাবে চলতে চলতে এক পর্যায়ে আবার দুজন এসে হাত খুলে দেয় কিন্তু চোখ বাধা অবস্থায় থাকে। হাঁটতে গিয়ে দেখি হাঁটা যাচ্ছে না, একপর্যায়ে ওদের দুই কাধের উপর আমার দুইহাতের ভর দিয়ে অনেক কষ্টে আমাকে যে রুমে রাখা হতো সেই রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার রুমে, যারা ছিলেন, তাদের একজন বলতেছিলো, ‘সুস্থ একটা মানুষকে নিয়ে দেখ কি করে দিছে, এদেরকে আল্লাহ মাফ করবে না’!