শেখ হাসিনার সহযোগীরা ২ লাখ কোটি টাকা সরিয়েছেন!

নয়াবার্তা ডেস্ক : বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ধনকুবের ও ব্যবসায়ীরা প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সহায়তায় ব্যাংক খাত থেকে ১৭ বিলিয়ন ডলার লুট ও পাচার করেছেন।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে (এফটি) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘সবল ব্যাংকগুলো দখলে নিতে হাসিনার ঘনিষ্ঠদের সাহায্য করেছে ডিজিএফআই। যে কোনো আন্তর্জাতিক মানদণ্ডেই এটি সবচেয়ে বড় এবং সর্বোচ্চ ব্যাংক ডাকাতি। এ মাত্রায় আর কোথাও ব্যাংক লুটপাটের ঘটনা ঘটেনি। আর এর পেছনে ছিল রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা।’ দেশ থেকে যে অর্থ দুবাই, সিংগাপুর বা অন্যান্য স্থানে পাচার করে নিজেদের আয়ত্তে রেখেছেন, তা উদ্ধারের চেষ্টায় আন্তর্জাতিক আইনি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হবে বলে জানান তিনি।

উল্লেখ্য, দেশের চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। গভর্নর যে পরিমাণ অর্থের কথা উল্লেখ করেছেন, তার পরিমাণ এ বাজেটের ২৫ শতাংশের সমান।

ফিনান্সিয়াল টাইমসে দেওয়া সাক্ষাৎকারে গভর্নর অভিযোগ করেন, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই (ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স) নেতৃস্থানীয় ব্যাংকগুলো জোরপূর্বক দখলের কাজে সহায়তা করেছিল।পরে যেখান থেকে ২ লাখ কোটি টাকারও বেশি অর্থ পাচার করা হয়।

গভর্নর বলেন, ব্যাংক দখলে নেওয়ার পর নতুন শেয়ারহোল্ডারদের ঋণ দেওয়া এবং আমদানি চালানে অতি মূল্যায়নের মাধ্যমে আনুমানিক ২ ট্রিলিয়ন টাকা বা ১ হাজার ৬৭০ কোটি মার্কিন ডলার লুট করা হয়েছে। যার পুরো টাকাই বিদেশে পাচার হয়েছে। বিশ্বের আর কোথাও এই খাতে এত লুটপাটের ঘটনা ঘটেনি এবং এর পেছনে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। গোয়েন্দারা ব্যাংকের দায়িত্বপ্রাপ্তদের মাথায় বন্দুক না ধরলে এটি করা সম্ভব হতো না।

তিনি বলেন, এস আলমের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম এবং তার সহযোগীরা ডিজিএফআই-এর সহায়তায় ব্যাংকগুলো দখলে নেওয়ার পর এই খাত থেকে ন্যূনতম ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার লুট করেছে। প্রতিদিনই তারা নিজেদেরকে ঋণ দিতো।

শেখ হাসিনা শাসনামলে ভোট কারচুপি, বিরোধীদের জেল ও নির্যাতন এবং ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী গত ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যান। হাসিনার পলায়নের পর নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। এই সরকার পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। গত মাসে এফটি এর সঙ্গে এক বৈঠকে আহসান মনসুর বলেছিলেন, হাসিনার সহযোগীদের বৈদেশিক সম্পদের তদন্তে যুক্তরাজ্যের সহায়তা চেয়েছেন তিনি।  

ফিনান্সিয়াল টাইমসে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে মনসুর দবি করেন, হাসিনার শাসনামলে নেতৃস্থানীয় ব্যাংকের বোর্ড সদস্যদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল। বোর্ডের সদস্যদের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা তাদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে হোটেলে বা অন্য কোনো স্থানে নিয়ে যেত এবং বন্দুকের মুখে তাদের ব্যাংকের সমস্ত শেয়ার এস আলমের কাছে বিক্রি করতে এবং তাদের পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করতে বলত। একের পর এক ব্যাংকে তারা এটা করেছে।

এই সব অভিযোগের বিষয়ে সাইফুল আলমের পক্ষে ল ফার্ম কুইন ইমানুয়েল উরকুহার্ট অ্যান্ড সুলিভানের দেওয়া এক বিবৃতিতে এস আলম গ্রুপ বলছে, আহসান মনসুরের এই অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই। এস আলম গ্রুপ এবং বাংলাদেশের অন্যান্য নেতৃস্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তী সরকারের অপপ্রচার সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়ার মৌলিক নীতি বহির্ভূত, যা ইতোমধ্যেই বিনিয়োগকারীদের আস্থা ক্ষুণ্ন করেছে এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতিতে ভূমিকা রেখেছে। এই গ্রুপের অতীত রেকর্ড এবং অবদানের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের কাছে গভর্নরের অভিযোগগুলোকে অবিবেচনা প্রসূত- বিস্ময়কর মনে হয়েছে।

ফিনান্সিয়াল টাইমস বলছে, এ বিষয়ে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর মিডিয়া উইং আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) মন্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হলেও তারা কোনো জবাব দেননি। এছাড়া এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য ডিজিএফআই-এর সাথেও যোগাযোগ করা যায়নি।

এদিকে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের সাবেক সিইও মোহাম্মদ আবদুল মান্নান ফিনান্সিয়াল টাইমসকে জানিয়েছেন, ২০১৩ সাল থেকে তিনি তৎকালীন সরকার-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চাপে পড়েছিলেন। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে একটি বোর্ড মিটিংয়ে যাওয়ার পথে তাকে তুলে নেওয়া হয় এবং পরে একজন সিনিয়র প্রতিরক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে তাকে দেখা করতে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করার জন্য পুরো এক দিন বসিয়ে রাখা হয়েছিল। তিনি বলেন, তারা ভুয়া স্টেশনারি দিয়ে ব্যাংকের চিঠি তৈরি করে। আমাকে একটি পদত্যাগপত্রে সই করতে হয়েছিল।

গত সেপ্টেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছেন মান্নান।

গভর্নর মনসুর বলেন, হাসিনার সরকারের আমলে দেউলিয়া হওয়া প্রায় ডজন খানেক ব্যাংকের অডিট শেষ করে লুট হওয়া অর্থ পুনরুদ্ধারের লক্ষ্য নিয়েছে বাংলাদেশ। আমরা সাম্প্রতিক অডিটগুলোকে আন্তর্জাতিক এবং দেশীয়ভাবে আইনের আদালতে প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার করতে চাই।

Share