প্রবাসী আয়ে মোট রিজার্ভ ছাড়িয়েছে ২৬ বিলিয়ন ডলার

৯ মাসে এসেছে ২২ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন

গাজী আবু বকর : হুন্ডির দৌরাত্ম্য কমে যাওয়ার পাশাপাশি খোলা বাজারের মতোই ডলারের দাম পাওয়ায় বৈধপথে বাড়ছে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাস ১২ দিনে এসেছে ২২ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার। আর গত ১২ দিনে এসেছে ১০৫ কোটি ২৩ লাখ ৬০ হাজার বা ১ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলারের প্রবাসী আয়। বাংলাদেশী মূদ্রায় প্রতি ডলার ১২৩ টাকা হিসাবে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ১২ হাজার ৯৪৪ কোটি ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। রেমিট্যান্সের এই তেজি আগমনের ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভেও ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী, রিজার্ভ বেড়ে হয়েছে ২১ দশমিক ১১ বিলিয়ন বা ২ হাজার ১১১ কোটি ডলার। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মোট মজুত বা রিজার্ভ ২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৬৩৯ কোটি ডলার। গত ১৩ এপ্রিল রোববার এ তথ্য জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান।

গত ১০ এপ্রিল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের নির্দেশিত বিপিএম-৬ মানদণ্ড অনুযায়ী বর্তমানে রিজার্ভ রয়েছে ২ হাজার ৮৯ কোটি ৯৭ লাখ ৭০ হাজার বা ২০ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলার। আর গ্রস রিজার্ভ রয়েছে ২ হাজার ৬১৪ কোটি ৯০ লাখ ৬০ হাজার বা ২৬ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার।

প্রবাসী আয়ের উপর বাংলাদেশ ব্যাংকের গত ১৩ এপ্রিল রোববার প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, দেশের ইতিহাসে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাস এবং এপ্রিলের প্রথম ১২দিন মিলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা ২ হাজার ২৮৩ কোটি ৬৭ লাখ ৫০ হাজার বা ২২ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন।বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতি ডলার ১২৩ টাকা হিসাবে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখ ৮০ হাজার ৮৯২ কোটি ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। সেই সাথে এই ৯ মাসে প্রবাসী আয়ে পর পর দুটি রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। এর একটি বিজয়ের মাস গত ডিসেম্বরে এবং অন্যটি স্বাধীনতার মাস সদ্য শেষ হওয়া মার্চ মাসে।এর আগে দেশের ইতিহাসে করোনাকালীন ২০২০ সালের জুলাই মাসে ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ ১০ হাজার বা ২ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিলো। সেই রেকর্ড ভেঙে গত বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে প্রবাসীরা ২৬৩ কোটি ৮৭ লাখ ৮০ হাজার বা ২ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠায়। মাত্র দু’মাসের মাথায় স্বাধীনতার মাস মার্চে প্রবাসীরা ৩২৯ কোটি ৫৬ লাখ ৩০ হাজার বা ৩ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়ে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে।একক মাস হিসাবে গত মার্চের আগে কখনোই এত পরিমাণ রেমিট্যান্স আসেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যানে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

উল্লেখ্য, প্রবাসী আয় হলো দেশে ডলার জোগানের একমাত্র দায়বিহীন উৎস। কারণ, এই আয়ের বিপরীতে কোনো বিদেশি মুদ্রা খরচ করতে হয় না বা কোনো দায়ও পরিশোধ করার দরকার পড়ে না। অন্যদিকে রপ্তানি আয়ের বিপরীতে দেশে ডলার এলেও তার জন্য কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি করতে আবার বিদেশি মুদ্রা খরচ করতে হয়। আবার বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতেও ডলারের প্রয়োজন হয়। ফলে প্রবাসী আয় বাড়লে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ডলারের রিজার্ভ বা মজুত দ্রুত বৃদ্ধি পায়।প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যাংকগুলোয় ডলারের যে সংকট চলছিল, তা অনেকটা কেটে গেছে বলে জানান কর্মকর্তারা। তাঁরা বলেন, ডলারের দাম নিয়ে যে অস্থিরতা ছিল, তা-ও কিছুটা কমে এসেছে। ব্যাংকগুলো এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া সর্বোচ্চ ১২৩ টাকার মধ্যেই প্রবাসী আয় কিনছে।সাধারণত দুই ঈদের আগে প্রবাসী আয় বছরের অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি আসে। তবে এবারের ঈদে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।দেশে গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর টানা ৭ মাস ধরে প্রতি মাসে ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত জুলাইয়ে ছাত্র আন্দোলনের সমর্থনে প্রবাসী বাংলাদেশিরা রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছিল। ফলে কমে যায় রেমিট্যান্স আসার পরিমাণ।তবে দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গত আগস্টের পর থেকে প্রতি মাসেই বাড়ছে প্রবাসী আয়ের গতি। একই সঙ্গে কমছে হুন্ডি ও অর্থপাচার। আবার খোলাবাজারের মতোই ব্যাংকে রেমিট্যান্সের ডলারের দাম পাওয়া যাচ্ছে। এসব কারণে প্রবাসীরা বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। তাছাড়া ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে গত মাসেবাড়ে রেমিট্যান্স আসার গতিপ্রবাহ।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম৮ মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১৮ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন বা১ হাজার ৮৪৮ কোটি ৮৭ লাখ ৫০ হাজার ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে আসে ১৪ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন বা১ হাজার ৪৯৪ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স। সে হিসাবে গত অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসের চেয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে রেমিট্যান্স বেড়েছে ৩৫৫ কোটি ডলার।

এর আগে অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে আসে ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ ৭০ হাজার ডলার, আগস্টে আসে ২২২ কোটি ৪১ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার, সেপ্টেম্বরে আসে ২৪০ কোটি ৪১ লাখ ১০ হাজার মার্কিন ডলার, অক্টোবরে আসে ২৩৯ কোটি ৫০ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার, নভেম্বরেআসে ২১৯ কোটি ৯৯ লাখ ৯০ হাজার মার্কিন ডলার, ডিসেম্বরে আসে ২৬৩ কোটি ৮৭ লাখ ৮০ মার্কিন ডলার, যা ছিলো এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ রেকর্ড। জানুয়ারিতে আসে ২১৮ কোটি ৫২ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার, ফেব্রুয়ারিতে আসে ২৫২ কোটি ৭৬ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার, এবং মার্চে এলো ৩২৯ কোটি বা ৩ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স।
প্রবাসীদের পাঠানো আয় আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যাংকগুলো উদ্বৃত্ত ডলার বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বিক্রি করছে। ব্যাংকগুলো থেকে ডলার কিনলে আর বিদেশি ঋণ ও অনুদান এলেই কেবল রিজার্ভ বাড়ে। এতে বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।

রিজার্ভ বৃদ্ধি পাওয়ায় বৈদেশিক লেনদেনের ওপর চাপ কমেছে। ডলারের দাম না বেড়ে ১২৩ টাকার মধ্যে আটকে রয়েছে। পাশাপাশি অনেক ব্যাংক এখন গ্রাহকদের চাহিদামতো ঋণপত্র খুলতে পারছে। ফলে বাজারে পণ্যের সরবরাহ এবং দাম স্বাভাবিক রয়েছে।

Share