১০ মাসে এসেছে ২৫ বিলিয়ন ডলার

অর্থপাচার বন্ধের কারণে বাড়ছে রেমিট্যান্স

গাজী আবু বকর : দেশ থেকে অর্থপাচার বন্ধের কারণে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানোর হার প্রতি মাসেই বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে ২৫ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। অর্থবছর শেষে এর পনিমাণ ৩০ বিলিয়ন ছাড়াতে পারে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক আশাবাদ ব্যাক্ত করেছে।

প্রবাসী আয়ের উপর বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেশের ইতিহাসে চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা ২ হাজার ৪৮৫ কোটি বা ২৪ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতি ডলার ১২৩ টাকা হিসাবে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ লাখ ১১ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। সেই সাথে এই ১০ মাসে প্রবাসী আয়ে পর পর ৩টি রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। এর একটি বিজয়ের মাস গত ডিসেম্বরে এবং অন্যটি স্বাধীনতার মাস মার্চ মাসে।এর আগে দেশের ইতিহাসে করোনাকালীন ২০২০ সালের জুলাই মাসে ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ ১০ হাজার বা ২ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিলো। সেই রেকর্ড ভেঙে গত বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে প্রবাসীরা ২৬৩ কোটি ৮৭ লাখ ৮০ হাজার বা ২ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠায়। মাত্র দু’মাসের মাথায় স্বাধীনতার মাস মার্চে প্রবাসীরা ৩২৯ কোটি ৫৬ লাখ ৩০ হাজার বা ৩ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়ে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে। সদ্য শেষ হওয়া এপ্রিল মাসে ২ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স আসার আরেকটি ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। যদিও একক মাস হিসাবে গত মার্চের ইতিহাস সর্বোচ্চ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যানে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

খাত সংশ্লিষ্টরা বরছেন, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত বছরের জুলাইজুড়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। আন্দোলন দমাতে মরিয়া হয়ে ওঠে তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকার। নির্বিচারে গুলি চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে এবং আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করে দেন প্রবাসীরা। এতে হঠাৎ কমে যায় রেমিট্যান্স প্রবাহ। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এরপর সরকারের আহ্বানে বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠানো শুরু করেন প্রবাসীরা। বাড়তে থাকে রেমিট্যান্স। প্রবাসী আয়ে দেশ গড়ে একের পর এক রেকর্ড।

উল্লেখ্য, প্রবাসী আয় হলো দেশে ডলার জোগানের একমাত্র দায়বিহীন উৎস। কারণ, এই আয়ের বিপরীতে কোনো বিদেশি মুদ্রা খরচ করতে হয় না বা কোনো দায়ও পরিশোধ করার দরকার পড়ে না। অন্যদিকে রপ্তানি আয়ের বিপরীতে দেশে ডলার এলেও তার জন্য কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি করতে আবার বিদেশি মুদ্রা খরচ করতে হয়। আবার বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতেও ডলারের প্রয়োজন হয়। ফলে প্রবাসী আয় বাড়লে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ডলারের রিজার্ভ বা মজুত দ্রুত বৃদ্ধি পায়। প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যাংকগুলোয় ডলারের যে সংকট চলছিল, তা অনেকটা কেটে গেছে বলে জানান কর্মকর্তারা। তাঁরা বলেন, ডলারের দাম নিয়ে যে অস্থিরতা ছিল, তা-ও কিছুটা কমে এসেছে। ব্যাংকগুলো এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া সর্বোচ্চ ১২৩ টাকার মধ্যেই প্রবাসী আয় কিনছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে আসে ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ ৭০ হাজার বা ১ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার, আগস্টে আসে ২২২ কোটি ৪১ লাখ ৫০ হাজার বা ২ দশমিক ২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, সেপ্টেম্বরে আসে ২৪০ কোটি ৪১ লাখ ১০ হাজার বা ২ দশমিক ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, অক্টোবরে আসে ২৩৯ কোটি ৫০ লাখ ৮০ হাজার বা ২ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, নভেম্বরে আসে ২১৯ কোটি ৯৯ লাখ ৯০ হাজার বা ২ দশমিক ১৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ডিসেম্বরে আসে ২৬৩ কোটি ৮৭ লাখ ৮০ হাজার বা ২ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ছিলো ঐ সময়কাল পর্যন্ত সর্বোচ্চ রেকর্ড। জানুয়ারিতে আসে ২১৮ কোটি ৫২ লাখ ৩০ হাজার বা ২ দশমিক ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ফেব্রুয়ারিতে আসে ২৫২ কোটি ৭৬ লাখ ৫০ হাজার বা ২ দশমিক ৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, মার্চে আসে সকল রেকর্ড ভাঙা ৩২৯ কোটি ৫৬ লাখ ৩০ হাজার বা ৩ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স। আর গত এপ্রিলে এসেছে ২৭০ কোটি বা ২ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স।
প্রবাসীদের পাঠানো আয় আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যাংকগুলো উদ্বৃত্ত ডলার বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বিক্রি করছে। ব্যাংকগুলো থেকে ডলার কিনলে আর বিদেশি ঋণ ও অনুদান এলেই কেবল রিজার্ভ বাড়ে। এতে বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।

রেমিট্যান্স বাড়ার নেপথ্যে কারণ সমূহ : দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ এবং ডলারের বিনিময় হার নিয়ে চিন্তার কিছু নেই বলে জানিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ হিসেবে সংস্থাটি বলছে, অর্থপাচার বন্ধের কারণে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স বাড়ছে। চলতি অর্থবছর রেমিট্যান্স ৩০ বিলিয়ন ছাড়াতে পারে।

এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘রিজার্ভ ও বিনিময় হার নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। অর্থপাচার বন্ধের কারণে রেমিট্যান্স বাড়ছে। আবার রপ্তানিও বাড়ছে। সরকার পরিবর্তনের পর রিজার্ভ থেকে এক ডলারও বিক্রি না করে বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হয়েছে।’

খোলাবাজার ও ব্যাংক রেটের মধ্যে ব্যবধান থাকায় হুন্ডিকে প্রাধান্য দিয়ে আসছিলেন প্রবাসীরা। বেশি টাকা পেতে ঝুঁকি থাকলেও অবৈধ পথে তারা পরিবারের জন্য অর্থ পাঠিয়ে আসছিলেন। তবে সেপথ এখন বন্ধ। একদিকে পাচার থেমেছে, অন্যদিকে রেমিট্যান্সের ডলারে খোলাবাজার ও ব্যাংক রেটের ব্যবধান কমেছে। এখন একই রেটে পাওয়া যাচ্ছে। এতে আর ঝুঁকি নিয়ে অবৈধ পথে অর্থ পাঠাচ্ছেন না প্রবাসীরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোরতার কারণে হুন্ডি দৌরাত্ম্যও কমেছে। এসব কারণে বাড়ছে রেমিট্যান্স।

বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে ইউটিউব, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে প্রবাসীদের প্রচারও ভালো কাজ করছে। এতে সাড়াও পাচ্ছে ব্যাংক, বাড়ছে রেমিট্যান্সের গতি। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পরই প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে ব্লগ তৈরি করেন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্য, সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেন, ড. কনক সারওয়ারসহ আরও অনেকে। তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতার জন্য বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠাতে প্রবাসীদের আহ্বান জানান। যার ফলস্বরূপ এখন প্রতি মাসেই আড়াই বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাচ্ছে প্রবাসী আয়।

বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠাতে প্রবাসীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করছে হাইকমিশন ও বাংলাদেশ কনসুলেট। বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাসগুলো প্রবাসীদের বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠাতে আরও উদ্বুদ্ধ করছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ হাইকমিশন এবং বাংলাদেশ কনসুলেট জেনারেল সিডনির উদ্যোগে প্রবাসীদের নিয়ে এ বিষয়ে সভা অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে সিডনির বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল মো. শাখাওয়াত হোসেন, বাংলাদেশ হাইকমিশন ক্যানবেরার চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ড. দেওয়ান মো. শাহারিয়ার ফিরোজসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। অন্য দেশের হাইকমিশনও একই ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকারের আহ্বানে।

অতিরিক্ত প্রণোদনা পাচ্ছেন রেমিট্যান্সযোদ্ধারা : বর্তমানে প্রতি রেমিট্যান্সের এক ডলারে পাওয়া যাচ্ছে ১২২ টাকা, এর সঙ্গে আরও আড়াই শতাংশ প্রণোদনা রয়েছে। তবে ব্যাংকগুলো চাইলে এর সঙ্গে আরও অতিরিক্ত ১ শতাংশ প্রণোদনা দিতে পারবে। অনেক ব্যাংকই এখন আড়াই শতাংশের সঙ্গে অতিরিক্ত আরও ১ শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। সেক্ষেত্রে রেমিট্যান্স ডলারের দাম পাওয়া যাচ্ছে ১২৫ টাকার মতো।

Share