দুই হাত পেছনে নিয়ে পরানো হাতকড়ায় আসামির কাঠগড়ায় সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক

আদালত প্রতিবেদক : ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত আটটা। একটা নীল রঙের প্রিজন ভ্যান হুইসেল বাজিয়ে পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজার মোড় হয়ে ঢাকার চিফ মেট্রপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের প্রধান ফটকে প্রবেশ করে।

প্রিজন ভ্যান ঢুকতে দেখে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের নেতারা সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের শাস্তি চেয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। প্রিজন ভ্যানটি দ্রুতগতিতে ঢাকার সিএমএম আদালতের হাজতখানার ভেতরে ঢুকে যায়। সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক যখন আদালতের হাজতখানায়, তখন হাজতখানার সামনে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের নেতারা তাঁর শাস্তির দাবিতে মিছিল করতে থাকেন।

তখন ঢাকা মহানগর পুলিশের প্রসিকিউশন বিভাগের প্রধান উপকমিশনার (ডিসি) তারেক জুবায়ের সিএমএম আদালতের প্রধান ফটক দিয়ে ওপরে ওঠেন। পুলিশ সদস্যদের কড়া নির্দেশনা দেন, কেউ যেন কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটাতে না পারে। আদালতে প্রবেশের সবগুলো ফটক বন্ধ করা হয়।

আদালতের সামনে অবস্থান নেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। তখন হাজতখানার ভেতর থেকে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে বের করা হয়। তাঁকে আদালতের সামনের সড়ক দিয়ে না নিয়ে আদালতের ভেতরের একটি রাস্তা দিয়ে আদালতের সিঁড়ির কাছে নিয়ে আসা হয়।

তখন দেখা যায়, সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের দুই হাত পেছনে নিয়ে পরিয়ে দেওয়া হয়েছে হাতকড়া। বুকে পুলিশের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট। তাঁর পরনে ছিল সাদা শার্ট আর কালো রঙের প্যান্ট। পায়ে চামড়ার স্যান্ডেল। নিচতলা থেকে দুই পুলিশ সদস্য তাঁর দুই বাহু ধরে রাখেন। পরে দুই পুলিশ সদস্যের বাহুর ওপর ভর দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে হেঁটে তিনি আদালতের তিনতলায় ওঠেন। পরে তাঁকে নেওয়া হয় আসামির কাঠগড়ায়। তিনি যখন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাঁর দুই হাত পেছনে নিয়ে পরিয়ে দেওয়া হাতকড়া খোলার উদ্যোগ নেন একজন পুলিশ সদস্য। সাবেক প্রধান বিচারপতি মাথা নিচু করে ছিলেন। তখন একজন পুলিশ সদস্য তাঁর হাতকড়া খুলে দেন। এ সময় সাবেক প্রধান বিচারপতির ডান হাতে ঝুলছিল হাতকড়া। তিনি কাঠগড়ার মাঝখানে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের অন্তত এক শ নেতা-কর্মী। আর ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা।

তখন সময় রাত ৮টা ১০ মিনিট। ঢাকার সিএমএম আদালতের অ্যাডিশনাল চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (এসিএমএম) মো. ছানাউল্লাহ খাস কামরা থেকে এজলাসে আসেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ম্যাজিস্ট্রেটের দিকে একনজর তাকান। এরপর মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকেন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো সাবেক প্রধান বিচারপতি হিসেবে এ বি এম খায়রুল হককে আজ সকালে গ্রেপ্তার করা হয় রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে। পরে তাঁকে নেওয়া হয়েছিল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে।

‘আওয়ামী লীগের একজন কর্মীর মতো আচরণ করেছেন’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র–জনতার আন্দোলনে গত বছরের ১৮ জুলাই রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে নিহত হন যুবদল কর্মী আবদুল কাইয়ুম। এ ঘটনায় যাত্রাবাড়ী থানায় দায়ের করা হত্যা মামলার আসামিদের তালিকায় রয়েছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। এই হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা যাত্রাবাড়ী থানার পরিদর্শক খালেদ হাসান সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন। খালিদ হাসান লিখিতভাবে আদালতকে বলেন, ২০১১ সাল থেকে সাবেক প্রধান বিচারপতি থাকাকালে আসামি এ বি এম খায়রুল হক বিভিন্ন সময়ে অপরাধমূলক বিশ্বাস ভঙ্গ করেছেন, জাল–জালিয়াতি করেছেন। জালিয়াতি করে প্রকৃত রায় হিসেবে ব্যবহারের মাধ্যমে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানায় মামলা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে ফতুল্লা থানাতেও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি থাকাকালে শপথ ভঙ্গের অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা হয়েছে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আদালতকে বলেন, ‘আসামি একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাঁকে জামিন দিলে তদন্তকাজে বিঘ্ন ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। তাঁকে জামিন দিলে ছাত্র–জনতা ও রাজনৈতিক দলগুলো উত্তেজিত হয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। তাই বিচারের পূর্ব পর্যন্ত তাঁকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করছি।’

কারাগারে আটক রাখার পক্ষে আদালতে বাদীপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের ঢাকা বার ইউনিটের সভাপতি খোরশেদ আলম। তিনি আদালতকে বলেন, ‘শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা বানানোর প্রধান কারিগর হলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। তিনি ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করেছিলেন। জালিয়াতির মাধ্যমে রায়কে সঠিক হিসেবে ব্যবহার করেছেন।’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে তিনি শেখ হাসিনাকে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনায় পরিণত করেছেন। তিনি বিচার বিভাগের কলঙ্ক। উনি বিচার বিভাগের সম্মানকে ভূলুণ্ঠিত করেছেন। আওয়ামী লীগের একজন কর্মীর মতো আচরণ করেছেন।’

আইনজীবী খোরশেদ আলম বলেন, ‘মাননীয় আদালত, মানুষ বিচার বিভাগকে সম্মান করে। আদালত হচ্ছে মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল। ওনার মতো দলীয় বিচারপতির কারণে বিচারপতিদের সম্মান ক্ষুণ্ন হয়েছে।’

এই আইনজীবী যখন এসব কথা বলছিলেন, তখন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে এসব কথা শুনতে থাকেন। তাঁর চোখেমুখে ছিল হতাশার ছাপ।

আইনজীবী খোরশেদ আলম বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে বাংলাদেশকে নরকে পরিণত করেছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক। বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম থেকে আমাদেরকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, আমাদের কোনো নেতা–কর্মী যেন সাবেক এই প্রধান বিচারপতিকে শারীরিকভাবে আঘাত না করেন।’

আইনজীবী খোরশেদ আলম বলেন, ‘মাননীয় আদালত, সাধারণ মানুষ যেভাবে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে ঘৃণা করেন, ঠিক একইভাবে সাবেক এই প্রধান বিচারপতিকেও মানুষ ঘৃণা করেন। আমরা ধন্যবাদ জানাচ্ছি অন্তর্বর্তী সরকারকে গণতন্ত্র হত্যা করার জন্য দায়ী এই সাবেক প্রধান বিচারপতিকে গ্রেপ্তার করার জন্য। কিন্তু কেন তাঁকে আজ রাতে নিয়ে আসা হলো। কারণ, দিনের বেলা জনগণ খবর পেলে এই আদালতে চলে আসতেন।’

ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি খোরশেদ আলম বলেন, ‘আমরা মনে করি, ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও তাঁর পেটোয়া বাহিনী নির্বিকারে সাধারণ ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা করেছে। এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। আমরা মনে করি, প্রত্যেকটি হত্যা মামলায় সাবেক এই প্রধান বিচারপতিকে আসামি করা উচিত। আমরা আইনের শাসনে বিশ্বাসী। যে কারণে ওনাকে কোনোভাবেই শারীরিকভাবে অসম্মানিত করা হয়নি, হচ্ছে না, হবেও না। কিন্তু উনি দলীয় বিচারপতির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।’

খোরশেদ আলম বলেন, ‘সাবেক তিন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে তাঁর বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করার মূল কারিগর এই সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক। উনি যদি ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল না করতেন, যদি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বহাল থাকত, তাহলে দেশের এই পরিস্থিতি হতো না। শেখ হাসিনাও স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারতেন না।’

জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের আরেক নেতা ও ঢাকা আইনজীবী সমিতির বর্তমান অ্যাডহক কমিটির সভাপতি খোরশেদ আলম মিয়া আদালতকে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আমাদের বয়স হয়েছে। আমরা ৪০ বছর ধরেই আইন পেশায় রয়েছি। বিচারপতিরা অবসরে গেলেও তাঁদের সম্মানের কোনো কমতি থাকে না। কিন্তু সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক অনেক পাপ করেছেন। আজ তিনি যে গ্রেপ্তার হলেন, তাতে কিছুটা হলেও তাঁর প্রায়শ্চিত্ত হয়েছে। আমরা মনে করি, শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার পেছনে এই সাবেক প্রধান বিচারপতি একমাত্র দায়ী।

বিগত ১৭ বছরে বিরোধী দলীয় শত শত নেতা–কর্মী গুম হয়েছেন, খুন হয়েছেন, ঘরছাড়া, বাড়িছাড়া, শত শত মামলা দিয়ে অবর্ণনীয় হয়রানি করা হয়েছে। শেখ হাসিনার এই নির্যাতনের প্রধান কারিগর হলেন এই সাবেক প্রধান বিচারপতি।’

আইনজীবী খোরশেদ আলম মিয়া যখন এসব কথা বলছিলেন, তখন আদালতকক্ষে উপস্থিত জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের নেতারা সমস্বরে বলতে থাকেন, ‘মাননীয় আদালত, উনি বিচার বিভাগের কলঙ্ক।’

সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হককে কারাগারে আটক রাখার পক্ষে আরও যুক্তি তুলে ধরেন অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আজিজুল হক ও আবুল কালাম খান।

এজলাসকক্ষে হঠাৎ অন্ধকার

রাত ৮টা ৩০ মিনিটের দিকে আদালতে বিদ্যুৎ–সংযোগ বন্ধ হয়ে যায়। তখন এজলাসকক্ষ হঠাৎ অন্ধকার হয়। এ সময় আইনজীবীরা তাঁদের মুঠোফোনের আলো জ্বালান। তখন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক কাঠগড়ার অগ্রভাগ থেকে পেছনে সরে যান। একাধিক পুলিশ সদস্য কাঠগড়ায় তাঁকে ঘিরে রাখেন।

রাষ্ট্রপক্ষ থেকে যখন বক্তব্য দেওয়া হচ্ছিল, তখন খায়রুল হক ম্যাজিস্ট্রেটের মুখের দিকে চেয়ে ছিলেন। আবার তিনি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে তাঁর সম্পর্কে যেসব বক্তব্য দেওয়া হচ্ছিল, তিনি শুনছিলেন। তাঁর পক্ষে আদালতে কোনো আইনজীবী ছিলেন না।
বাদীপক্ষের বক্তব্য শেষ হলে আদালত বলেন, যেহেতু তাঁকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করা হয়েছে, তাঁর পক্ষে জামিনের কোনো আবেদন করা হয়নি, এ পর্যায়ে তাঁকে কারাগারে আটক রাখার আদেশ দেওয়া হচ্ছে।

আদালতের আদেশ হওয়ার পর সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক মাথা নিচু করে ছিলেন। তখন একজন পুলিশ সদস্য তাঁর কাছে আসেন। তিনি দুই হাত পেছনে রাখেন। তখন তাঁর দুই হাতেই পরিয়ে দেওয়া হয় হাতকড়া। মাথায় পরানো হয় একটি হেলমেট। পরে দুজন পুলিশ সদস্য আবার তাঁর দুই বাহু ধরে রাখেন।

তিনি তিনতলা থেকে আস্তে আস্তে দুই পুলিশ সদস্যের বাহুর ওপর ভর করে নিচে নামতে থাকেন। যখন তিনি তিনতলার সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে দুই তলার কাছে আসেন, তখন তাঁর চোখেমুখে বিষণ্নতার ছাপ প্রকটভাবে ফুটে ওঠে।

এরপর দোতলা থেকে ধীরে ধীরে পুলিশ সদস্যদের বাহুর ওপর ভর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসেন। পরে তাঁকে আদালতের সামনের সড়ক দিয়ে না নিয়ে আবার আদালতের ভেতরের একটি পথ দিয়ে হাজতখানায় নেওয়া হয়।

তখন রাত নয়টা বাজে। সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে আবার প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়। প্রিজন ভ্যানটি কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের উদ্দেশে রওনা হয়।

Share