নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর রাজধানীর সকল বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি আদায় নিয়ে দ্বিমুখী সংকট সৃষ্টি হয়েছে। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের অভিভাবক তাদের সন্তানের টিউশন ফি পুরোপুরি মওকুফ করার দাবি জানিয়ে আসছে।
অন্যদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, ফি মওকুফ করা হলে প্রতিষ্ঠানের ভাড়া, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও কর্মচারীদের বেতন এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব নয়। তাই তারা পুরো ফি আদায়ে অটল।
দুর্যোগকালীন এ সংকটে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অনুমোদনের সময় বলেছিল, শিক্ষার প্রসারে ভূমিকা রাখবে। এখন শিক্ষাদানকে তারা বাণিজ্যিক করে ফেলেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো বছরের পর বছর ব্যবসা করেছে, এখন পাঁচ-ছয় মাস অভিভাবকদের একটু ছাড় দিতেই পারে। এ ক্ষেত্রে তারা সরকারের হস্তক্ষেপের কথা বলছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সমস্যা সমাধানের ওপর তারা গুরুত্বারোপ করছেন।
জানা গেছে, বেসরকারি স্কুলগুলোয় এমন দ্বিমুখী সংকট থেকে উত্তরণে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বা কোনোরকম আশ্বাসও মেলেনি। আবার বেসরকারি স্কুলগুলো বিভিন্ন রকম পাঠ্যক্রম পরিচালিত হওয়ায় এগুলোর ওপর আইনগতভাবে সরকারের তেমন নিয়ন্ত্রণও নেই।
অভিভাবকদের অভিযোগ, অধিকাংশ স্কুল এখন অনলাইনে ক্লাস পরিচালনা করলেও তারা বেতন নিচ্ছে স্বাভাবিক সময়ের মতোই। বেশ কয়েকটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের অভিভাবকরা স্কুল না খোলা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বেতন ৫০ শতাংশ কমানোর দাবিতে কর্মসূচি পালন করছে। তারা জানান, করোনার প্রাদুর্ভাবে এরই মধ্যে অনেক অভিভাবকের চাকরি চলে গেছে, কারও বেতন কমে গেছে। আর ব্যবসায় যুক্ত অভিভাবকেরা লোকসান মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছেন। এমন অবস্থায় স্কুলের টিউশন ফি পরিশোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের অভিভাবকদের একজন বলেন, মার্চের ১৭ তারিখ থেকে সরকারি আদেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। কবে স্কুল খোলা হবে তাও নিশ্চিত নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে তাদের ইলেক্ট্রিসিটি বিলসহ আরও অনেক খরচ এখন নেই। এ ছাড়া প্রতিবছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বেতন বাড়ায়, প্রত্যেক বছর ডেভেলপমেন্ট ফি বাবদ টাকা রাখে। এখন তারা সেই ফান্ড থেকে খরচ করুক। এত বছর তো ব্যবসা করেছে। এখন দুর্যোগে তারা অভিভাবকদের পাশে না দাঁড়িয়ে প্রতিনিয়ত টিউশন ফি আদায়ের চাপ দিচ্ছে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন ঐক্য পরিষদের মহাসচিব মো. রেজাউল হক জানান, তারা বড় ধরনের সংকটের মধ্যে আছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয় না থাকায় বেতনও পাচ্ছেন না শিক্ষকেরা। প্রায় ৯০ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভাড়া বাড়িতে। মাসের প্রথমেই পরিশোধ করতে হয় বাড়িভাড়া, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও কর্মচারীদের বেতন, অন্যান্য বিলসহ বাণিজ্যিক হারে বিদ্যুৎ ও পানির বিল। স্কুল বন্ধ থাকার কারণে এগুলোর প্রতিষ্ঠাতারা বাড়িভাড়া, শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন কোনো কিছুই পরিশোধ করতে পারেননি। তিনি বলেন, একদিকে বাড়িওয়ালার ভাড়ার চাপ, শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনের চাপ রয়েছে। অন্যদিকে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী স্বল্প আয়ের পরিবার থেকে আসায় তাদের অভিভাবকেরা বেতন মওকুফের দাবি জানিয়ে আসছেন।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, পুরো জাতি এখন একটি দুর্যোগকাল পার করছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যখন অনুমোদন নিয়েছিল, তখন তারা বলেছিল শিক্ষার প্রসারে ভূমিকা রাখবে। এখন শিক্ষাদানকে বাণিজ্যিক করে ফেলেছে। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলো বছরের পর বছর ব্যবসা করেছে, এখন এক বছর অভিভাবকদের একটু ছাড় দিতেই পারে। দেশের বৃহৎ অংশের লেখাপড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেই হয়। তাই এ বিশাল খাতকে সরকারের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হবে। চলমান দুর্যোগে শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষাপ্র তিষ্ঠান সবার স্বার্থেই সরকারেরর উচিত হস্তক্ষেপের মাধ্যমে একটি উপায় বের করা। কারণ এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার ক্ষতি হলে তা প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রেরই ক্ষতি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক প্রফেসর সৈয়দা তাহমিনা আখতারও মনে করেন উদ্ভূত সমস্যার সমাধানে সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বেশিরভাগ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভিভাবক সন্তানের টিউশন ফি মওকুফ বা অর্ধেকে নামিয়ে আনার দাবি জানালেও প্রতিষ্ঠানগুলো পুরো ফি আদায়ে চাপ সৃষ্টি করছে। টিউশন ফি পরিশোধ না করলে শিক্ষার্থীদের নতুন ক্লাসে উন্নীত না করা, অনলাইন ক্লাস থেকে বাদ দেওয়ার খবরও আসছে। এমতবস্থায় আমাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া চালিয়ে নিতে এ সংকটের সমাধান প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপ করা উচিত।
পুরো বিষয়টি নিয়ে কথা হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহাবুব হোসেনের সঙ্গে। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, স্কুল ও অভিভাবক দুই পক্ষকেই কিছুটা ছাড় দিয়ে মানবিক সমাধানে আসতে হবে। টিউশন ফি ছাড়া স্কুলগুলো চলবে কী করে? এমন প্রশ্ন রেখে তিনি যোগ করেন, যেসব অভিভাবক করোনার কারণে প্রকৃতই ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের সর্বোচ্চ ছাড় দিতে আমরা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইতোমধ্যেই আহ্বান জানিয়েছি। গণহারে সবার বেতন মওকুফ করা হলে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন হবে কী করে?
মো. মাহাবুব হোসেন বলেন, কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে টিউশন ফি নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে। এর বাইরে বেশিরভাগ শিক্ষাপ্র তিষ্ঠান সরকারি অথবা সরকারের এমপিও সুবিধা পাচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানে যাদের সন্তানরা পড়ালেখা করে, তারা তো বেতন মওকুফের দাবি করতে পারেন না। আর যারা ইংরেজি মাধ্যম, কিন্ডারগার্টেনে বাচ্চাদের পড়ান, তারা তো জেনেশুনেই অর্থাৎ ব্যয় বহন করার সামর্থ্য রেখেই ভর্তি করিয়েছেন।