WordPress database error: [Disk full (/tmp/#sql_140a_0.MAI); waiting for someone to free some space... (errno: 28 "No space left on device")]
SHOW FULL COLUMNS FROM `nb_postmeta`

নুসরাতের মৃত্যু আর কত নুসরাত এভাবে মরবে

আসিফ নজরুল : নুসরাত জাহানের মৃত্যুতে স্বজনদের আহাজারিনুসরাত জাহানের মৃত্যুতে স্বজনদের আহাজারিবুধবার রাতে বাসায় ফিরে শুনি, নুসরাত মারা গেছে। ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতের পঁচাত্তর শতাংশ অগ্নিদগ্ধ শরীর, বুকের হাড় পুড়ে বেঁকে যাওয়া, ফুসফুসে সংক্রমণের খবর জানতাম। ভাবতাম, এত তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে কীভাবে বাঁচে মেয়েটা। তার মৃত্যুর খবর শুনে পাষণ্ডের মতো বলি: ভালো হয়েছে এক দিক দিয়ে। তার যন্ত্রণার শেষ হয়েছে।

আসলেই তা হয়েছে কি? আমি ঠিক জানি না। তবে এটা জানি, যদি তার যন্ত্রণার শেষ হয়ে থাকে, তাহলে এখান থেকে আমাদের যন্ত্রণার শুরু হোক। শুরু হোক আমাদের দগ্ধ হওয়া। আত্মজিজ্ঞাসায়, আত্মবিশ্লেষণে।

আমরা দগ্ধ হই এটা ভেবে যে এমন সমাজ আমরা গড়ে তুলেছি, যেখানে একটা যৌন নিপীড়ক, দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসী ধরনের লোক মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসেবে থাকতে পারেন, তাঁর কুকর্মের পক্ষে কিছু মানুষকে নামাতে পারেন, একই মাদ্রাসায় নুসরাত নামের কিশোরী মেয়েকে যৌন নিপীড়ন করার দুঃসাহস তিনি পেতে পারেন।

নুসরাত এর প্রতিবাদ করে মামলা করেছিল। অন্যায়ের প্রতিবাদ করে অন্য দেশের কেউ বিশ্বখ্যাত হয়, কেউ নোবেল পুরস্কার পায়, কেউ জাতিসংঘের শুভেচ্ছাদূত হয়। আমাদের মতো অভাগা দেশে ঘটে উল্টো ঘটনা। আমাদের দেশে প্রতিবাদী নুসরাতকে মামলা করার কারণে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়।

আমরা তাই এটা ভেবে দগ্ধ হই যে আমাদের এই সমাজে ন্যায়বিচার চাওয়া একজন কিশোরীকে হত্যা করার দুঃসাহস করতে পারে কেউ, সেই হত্যাকাণ্ডকে আত্মহত্যা বলে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে স্বয়ং পুলিশ। আমরা এটা ভেবে দগ্ধ হই যে এমন পুলিশের সর্বোচ্চ শাস্তি হয় শুধু কর্মস্থল পরিবর্তন!

আমি জানি, কেউ কেউ ভাববে এসব তো এখনো অভিযোগ। যত সত্য মনে হোক, এখনো প্রমাণ হয়নি কিছু। কিন্তু আমরা তো জানি, এমন ঘটনা আসলে ঘটে এ দেশে। যে মাদ্রাসা, বিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের দায়িত্ব অভিভাবকত্বের, তাঁর হাতে নির্যাতিত হয় শিশু, বালিকা, কিশোরী। যে পুলিশের উচিত অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা, সে অপরাধকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। যে আদালতের উচিত অপরাধ প্রমাণ করে শাস্তি দেওয়া, সে আদালতে জামিন পেয়ে আসামি পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ বা মামলার সাক্ষীদের হুমকি দেওয়ার সুযোগ পান।

আমাদের তাই এটা ভেবে দগ্ধ হওয়া উচিত যে এসব অনাচার মেনে নিয়ে আমরাই নুসরাতদের জন্য একটি মৃত্যুবান্ধব পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছি। এ পরিস্থিতি পরিবর্তনের ভান-ভণিতা হয়েছে। এবারও হবে। কিন্তু অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করার মতো রাষ্ট্র আমরা তৈরি করতে পারিনি বলে আরও নুসরাতরা এ রকম বর্বরতার শিকার হতে থাকবে। এটাই সত্যি।

২.
অপরাধ পৃথিবীর সব দেশে হয়। কিন্তু বিচার হয় না সব দেশে। যে সমাজ সভ্য সমাজ থেকে যত দূরে, সেই অপরাধীর বিচারে তারা ততই অক্ষম আর অনীহ। আমাদের সমাজে বিচারের পদে পদে যে অলঙ্ঘনীয় বাধার প্রাচীর, আমরা তা অস্বীকার করি কীভাবে! এ দেশে অপরাধ হলে, বিশেষ করে তা যদি হয় যৌন নির্যাতন, তাহলে বিচারে প্রথম বাধা আসে পরিবার থেকে। রক্ষণশীল আর বিবেকহীন মানুষের সমালোচনার ভয়ে পরিবারই ধামাচাপা দেয় বহু যৌন নির্যাতনের ঘটনা।

পরিবার সাহসী হয়ে প্রতিবাদ করলে বাধা আসে অপরাধীর পক্ষের মানুষের কাছ থেকে। সোনাগাজীর মাদ্রাসা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সব জায়গায় অভিযোগ ধামাচাপা দিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন কিছু সহপাঠী, এমনকি কিছু শিক্ষক। যাঁরা চালাক-চতুর, তাঁরা এই ধামাচাপা দেওয়ার কাজটি করেন তদন্ত কমিটি গঠনের নামে। যাঁদের চালাকির প্রয়োজন নেই, তাঁরা ধামাচাপা দেন সরাসরি হুমকি দিয়ে।

পরিবার বা সমাজ ধামাচাপা দিতে ব্যর্থ হলে ধামাচাপা দেওয়ার কাজটি করে পুলিশ। আমাদের কি মনে আছে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় শহীদ মিনারে প্রকাশ্যে নির্যাতিত হওয়া মেয়েটির কথা। তাঁর ওপর অকথ্য নির্যাতনের বিচার হয়নি, বরং তিনি অভিযোগ করেছিলেন, বিচার চাইতে থানায় গিয়ে তিনি নির্যাতিত হয়েছিলেন আবার। আমরা কি এরপর আর কোনো অগ্রগতি শুনেছি এই ভয়ংকর অভিযোগের বিষয়ে?
পরিবার, সমাজ ও পুলিশের বাধা কোনোভাবে ডিঙানো গেলেও বিচার চাওয়ার পথে অনেক সময় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন। ফরেনসিক পরীক্ষায় ধর্ষণের আলামত খুঁজে পাওয়া যায় না। খুন হয়ে গেলেও বোঝা যায় না এটি খুন, নাকি দুর্ঘটনা, নাকি আত্মহত্যা।

তারপর শেষ বাধা থাকে আদালতে। এই আদালত নির্ভর করে পুলিশের তদন্ত রিপোর্ট, অদক্ষ কিংবা অনীহ সরকারি উকিলের তৎপরতা এবং মান্ধাতার আমলের আইন ও বিচারব্যবস্থার ওপর। এই আদালতের ওপরে আবার খবরদারি করার মানুষ থাকে। আসামির রাজনৈতিক পরিচয়ভেদে জামিন, বিচার বিলম্ব, এমনকি মুক্তির নির্দেশ আসে। সবশেষে থাকেন রাষ্ট্রপ্রধান। মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন পাওয়া আসামিকে তিনি ক্ষমা করে দিতে পারেন প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে, দেনও কখনো কখনো।

বাকি থাকি আমরা আমজনতা। কিন্তু আমাদের কাছেও অপরাধটা কী, সেই বিবেচনার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান হয়ে ওঠে অপরাধীর পরিচয়। যৌন নির্যাতক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হলে তাঁর পক্ষে দাঁড়িয়ে যায় কিছু মানুষ, মাদ্রাসার শিক্ষক হলে তাঁর পক্ষে দাঁড়ায় কিছু মানুষ, রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হলে আরও আগ্রাসীভাবে পক্ষে নেয় কিছু মানুষ। কোনো চেতনা, কোনো ধর্ম, কোনো রাজনীতি সমর্থন করে না ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন। কিন্তু এসবের নামেই ধর্ষক আর নির্যাতকের পক্ষে দাঁড়িয়ে যাই আমরা অনেকে।

৩.
এসব খারাপ কথা শুনতে বা বলতে ভালোবাসি না আমরা অনেকে। এ জন্য পাশবিক নৃশংসতা বা শোচনীয় দুর্ঘটনার মধ্যে আমরা বের করি আনন্দিত হওয়ার গল্প। চকবাজারে খুঁজি সাহসিকতার গল্প, বনানীতে মেতে উঠি পাইপের ওপর পাড়া দিয়ে বসে থাকা শিশুর গল্পে। মানবিকতা আর সাহসিকতার গল্পে দোষ নেই। কিন্তু এর আড়ালে ধামাচাপা পড়ে যায় অনেক আসল প্রশ্ন।

আসল প্রশ্ন হচ্ছে, চকবাজারে আগুন লাগার পর রাসায়নিক গুদাম আর অনিরাপদ গ্যাস সিলিন্ডার বিষয়ে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হলো না আজও? আসল প্রশ্ন হলো, এসব ঘটনার পর সরকার কি অগ্নিকাণ্ড থেকে মানুষকে বাঁচাতে অর্থবহ কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে? মানুষের বিপদে আমরা অন্য কোনো বাহিনীর চেয়ে বেশি আগুয়ান দেখি ফায়ার সার্ভিসকে। এদের সক্ষমতা ও সামর্থ্য বাড়ানোর কোনো চিন্তা কি সরকার করেছে?
প্রশ্ন আছে নুসরাতের ওপর নির্মমতার বিচার নিয়েও। নুসরাত চলে গেছে। পাষণ্ড অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার এবার হয়তো শাস্তি হবে। কিন্তু যে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতার ছত্রচ্ছায়ায় তিনি এতটা বেপরোয়া হতে পেরেছেন, সে মানুষগুলো বারবার তাঁর অপরাধ ধামাচাপা দিয়েছে, যে পুলিশ নুসরাতের হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে, তাদের উপযুক্ত শাস্তি কি হবে?

হবে না, হওয়ার তেমন কোনো নজির নেই এই পোড়া দেশে। কিন্তু যদি আমরা সত্যি চাই নুসরাতের মতো পরিণতি না হোক আর কারও, অপরাধ হলে প্রতিবাদ করার সাহস থাকুক আরও অনেক নুসরাতের, যদি আমরা সত্যি চাই অপরাধ করলে ভীত থাকুক অপরাধী, তাহলে আমাদের অবশ্যই অপরাধবান্ধব পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে হবে।

সিরাজ উদ দৌলার সঙ্গে সঙ্গে শাস্তি দিতে হবে তাঁর সব সহযোগীকে, তাঁর অপরাধ ধামাচাপা দেওয়ার মানুষের, বন্ধ করতে হবে তাঁর সব অনৈতিক ব্যবসা, রুখতে হবে তাঁর পক্ষের সুবিধাভোগীদের। না হলে নির্যাতিত হবে, পুড়বে আর মরবে আরও অনেক নুসরাত। এত নুসরাতের জন্য যথেষ্ট কান্না কি জমা আছে আমাদের চোখে?

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক

Share