রাষ্ট্রসংস্কার নির্বাচন এবং নতুন দল

ইয়াহিয়া নয়ন : শেখ হাসিনার সরকারের নির্মম পতনের ফলে যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা হাল আমলে সবাইকে ভোগাচ্ছে। তার বিদায়ের পর টানা চার দিন পুরো দেশ কার্যত সরকারবিহীন ছিল। তার পর একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয় বটে কিন্তু এই সরকারের আইনগত ভিত্তি-প্রশাসনিক কাঠামো এবং কর্মপরিধি ও ভবিষ্যৎ নিয়ে যেভাবে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়েছে, তার ফলে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্রের সর্বত্র একধরনের অনিশ্চয়তা-অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে।

রাষ্ট্রের মূল সমস্যাগুলো ছাইচাপা পড়ে যাচ্ছে এবং পতিত সরকারের দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী-এমপি-আমলা-কামলাদের বিরুদ্ধে মামলা-গ্রেফতার-রিমান্ড নিয়ে অতিরিক্ত মাতামাতি হচ্ছে। প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের সেই উপকথার মতো প্রতিদিনই নিত্যনতুন সার্কাসের দৃশ্য প্রদর্শিত হচ্ছে, আর আমরা সেই দৃশ্যে মাতোয়ারা হয়ে ভুলে যাচ্ছি আমাদের জীবনের প্রকৃত সমস্যা।

মানুষের মৌলিক চাহিদার পর যে অভাবটি মানুষকে সবচেয়ে বেশি পীড়া দেয় তার নাম রাজনীতি। আবার মানুষের সঠিক জীবনযাত্রায় দীর্ঘমেয়াদে সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের নিশ্চয়তাদানকারী পদ্ধতির নাম রাজনীতি। বর্তমান পৃথিবীতে টেকসই রাজনীতি বলতে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থার মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় পদ্ধতিটির নাম সংসদীয় ব্যবস্থা, যা একটি মহান বিপ্লবের মাধ্যমে ইংল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং ম্যাগনাকার্টা দলিলের মাধ্যমে আইনগত ভিত্তি লাভ করেছিল।
গণতন্ত্রের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য হলো- জনগণ ভোটের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ পায়। শত ত্রুটি ও শত দুর্বলতা সত্ত্বেও আজ অবধি জনগণের রায়ের বিকল্প কোনো ভালো পদ্ধতি পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আবিষ্কার করতে পারেননি। ইতিহাস থেকে আমরা জানি, সমাজের সুধীজন-জ্ঞানী-গুণী কিংবা সাধু-সন্ন্যাসীকে বহুবার রাজসিংহাসনে বসানো হয়েছে।

আবার বিক্ষুব্ধ জনতা তাদেরকে মেরে-কেটে তাড়িয়ে দিয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জীবন্ত কবর দিয়েছে নতুবা জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছে। তার পর আবার নিজেদের পছন্দমতো লোকের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা ন্যস্ত করেছে। ইতিহাসে এমনো নজির রয়েছে এবং যেখানে চোর-গুণ্ডা বা ডাকু প্রকৃতির লোককে জনগণ ভোট দিয়েছে এবং সাধুর পরিবর্তে ডাকুকে নিজেদের রাজা বা নেতা বানিয়ে মহাসুখে দিনাতিপাত করেছে।

ভারতে দস্যুরানী ফুলনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া কিংবা রাশিয়াতে পিটার দ্য গ্রেট, স্পেনে ফ্রাঙ্কো, ভারতবর্ষে অশোক দ্য গ্রেটকে ইতিহাসের মহানায়ক কিন্তু জনগণই বানিয়েছে অথচ তাদের জীবনের বিরাট অংশজুড়ে যে নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতা এবং দমনপীড়নের ইতিহাস ছিল, যা পাঠ করলে অনেকেরই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে।

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হলো বিদ্যাবুদ্ধিতে ও সফলতায় তারা রাষ্ট্রের অন্যতম উদাহরণযোগ্য মানুষ। আন্দোলনকারীদের মধ্যে থেকে যে দুই তরুণকে সরকারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তাদের ইতিবাচক দিক হলো তারা পুরো আন্দোলন প্রক্রিয়ার সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং চূড়ান্তপর্যায়ে এসে জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

অন্য দিকে সরকারের কর্তাদের নেতিবাচক দিক হলো তারা কেউই মূল ধারার রাজনীতির সাথে কোনোকালে জড়িত ছিলেন না। বরং ক্ষেত্র বিশেষে তাদের কারো কারো মনমস্তিষ্কে রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে ঘৃণা ক্ষোভ ও ক্রোধ রয়েছে। ফলে তাদের সামনে রাজনীতি গণতন্ত্র নির্বাচন নিয়ে বেশি কথা বললে তারা কেউ কেউ হয়তো মেজাজ হারিয়ে ফেলবেন।

এ অবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজকর্ম ধ্যান-ধারণার সাথে দেশের চলমান রাজনীতির যে দূরত্ব রয়েছে তা দিনে দিনে বাড়ছে। সরকার চাচ্ছে রাষ্ট্র সংস্কার করতে। রাজনৈতিক দলগুলো চাচ্ছে দ্রুত নির্বাচন। সরকারের পক্ষের লোকের দাবি রাজনৈতিক দলগুলো তো আন্দোলনে ব্যর্থ হয়েছে। ছাত্রদের সাহস রক্ত এবং বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে এবং সেই ছাত্রদের পছন্দের মানুষটি অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সুতরাং তারা রাষ্ট্রসংস্কার না করে নির্বাচন দেবেন না।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ এবং নির্বাসনে পাঠানোর মাধ্যমে অপ্রত্যাশিত জয় পেয়েছেন বাংলাদেশের প্রতিবাদী ছাত্র জনতা। এখন তারা তাদের দীর্ঘমেয়াদী ভবিষ্যত কী হবে তা নিয়ে আলোচনা করছেন। বাংলাদেশে আধিপত্য বিস্তারকারী দুটি দল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিএনপি।

এই দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের কথা বিবেচনা করছেন ছাত্ররা। মৌলিকভাবে গণতন্ত্র হলো রাজনৈতিক পছন্দ বেছে নেয়ার সুযোগ। সুতরাং বাংলাদেশি জনগণের যেকোনো সুযোগকে, যেমন ছাত্রদের পরিচালিত পার্টিকে স্বাগত জানানো উচিত। বর্তমান প্রেক্ষাপটে গণমানুষের আকাঙ্খাও তাই। দেশের শান্তিপ্রিয় জনতা রাজনীতিতে নতুন কিছু দেখতে চায়। সেই আকাঙ্খা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে ছাত্রদের বিপ্লব।

যদি ছাত্ররা দেশে একটি অর্থপূর্ণ পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে টেকসই, দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক প্রচারণায় বিকশিত হতে চান, তাহলে উদ্দেশ্য ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার চেয়ে তাদেরকে পরিবর্তনে সফলতা আনতে হবে। সুতরাং শিক্ষার্থীদের এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন যা, তাদের তাৎক্ষণিক দাবির পাশাপাশি তাদের পলিসিগত লক্ষ্য পরিষ্কারভাবে ফুটিয়ে তোলে, যেন তারা ভোটারদের সমর্থন চাইতে পারেন। এখন পর্যন্ত ভবিষ্যতের এসব রূপরেখা, যা তারা জাতির জন্য পরিকল্পনা করে- তা তুলে ধরেননি আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। হয়তো তারা যথাসময়ে তা জাতির সামনে তুলে ধরবেন। এক্ষেত্রে অতীত যদি পথপ্রদর্শক হয়, তাহলে এই কাজ বড় একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে প্রমাণিত হতে পারে।

ছাত্র আন্দোলনে রাজনৈতিক পরিবর্তনের এ অঞ্চল এবং বিশ্বজুড়ে দীর্ঘ ইতিহাস আছে। ভারতে বিরোধীদের সঙ্গে ছাত্রদের আন্দোলনে ১৯৭৭ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পতন হয়েছিল।

লালু প্রসাদ যাদব, নীতিশ কুমারসহ ওই আন্দোলনের অনেক ছাত্রনেতা তারপর থেকে দীর্ঘ ও সফল রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গড়েছেন। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া কথিত অভিবাসীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন। এর ফলে ১৯৮৫ সালে আসাম চুক্তি হয়। তারাই অসম গণপরিষদের ভিত্তি রচনা করে। এই দলটি ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এই রাজ্যটি (আসাম) শাসন করেছে। এরপর ১৯৯৬ সালে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসে।

একটু দুরে দৃষ্টি দিলে দেখতে পাই, অতি সম্প্রতি চিলিতে ছাত্র আন্দোলন থেকে নতুন রাজনৈতিক নেতাদের একটি প্রজন্ম সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে আছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট গাব্রিয়েল বোরিক। চিলিতে রোবিকের সরকার সমর্থিত একটি প্রগতিশীল নতুন সংবিধানের প্রচারণা পরাজিত হয় অথবা আসামে অসম গণপরিষদ তাদের মূল সংশ্লিষ্টতা থেকে হারিয়ে যায়। সেইসব ঘটনা থেকে বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিবিদদেরকে নির্বাচনী গণতন্ত্রের পরীক্ষায় পাস করতে হবে। ভোটাররা যে সিদ্ধান্ত দেবেন তা মেনে নিতে প্রস্তুত থাকতে হবে। এটাও তাদের জন্য একটি নতুন পরীক্ষা। আন্দোলনকারী ছাত্র জনতা সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হোক এই প্রত্যাশা দেশবাসীর।

লেখক : সাংবাদিক।

Share