সম্প্রতি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের মিডটার্ম পরীক্ষার শিক্ষার্থীদের একটি প্রশ্ন করা হয়েছিল। ‘শয়তান দেহ পাবি, মন পাবি না’ উদ্ধৃতি উল্লেখ করে ‘ব্রিটিশ হেজিমনি’র আলোকে সেটির বিস্তারিত বর্ণনা করতে বলা হয়। এরপর বিষয়টি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয়েছে জোর আলোচনা। ঢাকাই সিনেমার চালু এ সংলাপ আদতে কোন বয়ান হাজির করে আমাদের কাছে?
‘শয়তান দেহ পাবি, মন পাবি না’—ঢাকাই সিনেমায় নায়িকাদের মুখে এ সংলাপ শোনেননি এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। খলচরিত্রের যৌন আগ্রাসনের মুখে এটাই শেষ হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায় ‘অবলা’ নারীর। সম্ভ্রম, এমনকি জীবন হারালেও তাঁর কাছে রয়ে যাবে তাঁর সর্বোচ্চ সম্পদ—মন বা মনন, যা তিনি হয়তো সমর্পণ করবেন স্বেচ্ছায়। আরেকটু খোলাসা করলে বলা যাবে, তাঁর চিন্তার শক্তি নেওয়ার ক্ষমতা কারও নেই।
এ সংলাপ প্রথম কোন সিনেমায় ব্যবহৃত হয়েছিল, তা খুঁজে বের করা এখন প্রায় অসম্ভব। কিন্তু সংলাপটি এমনভাবেই আমাদের সামষ্টিক অবচেতনে গেঁথে গেছে যে কয়েক দশক ধরেই ঠাট্টা-মশকরায় আমাদের মুখে মুখে ফিরেছে এটি। এর কারণ হয়তো, শাসকের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিম্নবর্গের এটাই সবশেষ প্রতিরোধ।
সম্প্রতি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের মিডটার্ম পরীক্ষার শিক্ষার্থীদের একটি প্রশ্ন করা হয়েছিল। ‘শয়তান দেহ পাবি, মন পাবি না’ উদ্ধৃতি উল্লেখ করে ‘ব্রিটিশ হেজিমনি’র আলোকে সেটির বিস্তারিত বর্ণনা করতে বলা হয়। সেই প্রশ্নপত্রের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করার পর পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে ‘হেজিমনি’ বোঝানোর জন্য এ সংলাপ ব্যবহারের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকে সংলাপটিকে অশ্লীলও বলেছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, এটি যদি সিনেমার না হয়ে কোনো ধ্রুপদি সাহিত্যের উক্তি হতো, তাহলেও কি একই ধরনের আপত্তি বা একই ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি হতো?
শিল্প-সংস্কৃতির শ্রেণিবিন্যাসের এই চেষ্টা আদিম ও অবিরত। সভ্যতার শুরু থেকেই এটা হয়ে আসছে। মার্ক্সবাদী দার্শনিক আন্তোনিও গ্রামশির মতে, সাংস্কৃতিকভাবে বৈচিত্র্যপূর্ণ একটি সমাজে ক্ষমতাসীনের সংস্কৃতির আধিপত্যকেই বলা হয় ‘কালচারাল হেজিমনি’।
জনসংস্কৃতির বিস্তারিত ক্যানভাসের মধ্যে প্রকাশ ঘটে নিম্নবর্গের আচার, জীবনাচরণ, সর্বোপরি তার মননের। আর জনসংস্কৃতির পরিসরের মধ্যে নিম্নবর্গের অস্তিত্বের উদ্যাপনও ঘটে। যে অস্তিত্ব ক্রমাগত অভিঘাতে জীর্ণ ও পরাস্ত, সেই অস্তিত্বের টিকে থাকার লড়াইয়ে উদ্দীপনা জোগায় জনমুখী সংস্কৃতি এবং তার ওপর প্রভুত্ব স্থাপনের জন্য নানামাত্রিক তৎপরতা চালিয়ে যেতে থাকেন ক্ষমতাকাঠামোর ওপরের দিকে থাকা মানুষজন। অনেক আগ থেকেই খেলাটা এ ছকে হয়ে আসছে।
ক্ষমতাসীনের দর্শন, বিশ্বাস আর দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিষ্ঠা ঘটে কালচারাল হেজিমনির মাধ্যমে। গ্রামশির এ চিন্তার আরও প্রসার ঘটিয়েছেন আরেক মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক লুই আলথুসার। তিনি বলছেন, কোনো ধরনের শক্তি প্রয়োগ ছাড়াই ক্ষমতাসীন শ্রেণি তার আধিপত্য বজায় রাখতে পারে। সে ক্ষেত্রে শ্রমিকশ্রেণিকে মতাদর্শিকভাবে অধীন করতে হবে। অর্থাৎ ব্যক্তির চিন্তার শক্তিকে প্রভাবিত করতে হবে।
নব্য গ্রামশীয় তত্ত্বে ‘পপুলার কালচার’ বা জনসংস্কৃতি হচ্ছে সেই ক্ষেত্র, যেখানে সমাজের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর পক্ষের শক্তিগুলোর সমন্বিতকরণ আর শোষিত গোষ্ঠীর প্রতিরোধের মধ্যে ক্রমাগত সংঘাত চলছে। জনসংস্কৃতির বিস্তারিত ক্যানভাসের মধ্যে প্রকাশ ঘটে নিম্নবর্গের আচার, জীবনাচরণ, সর্বোপরি তার মননের। আর জনসংস্কৃতির পরিসরের মধ্যে নিম্নবর্গের অস্তিত্বের উদ্যাপনও ঘটে। যে অস্তিত্ব ক্রমাগত অভিঘাতে জীর্ণ ও পরাস্ত, সেই অস্তিত্বের টিকে থাকার লড়াইয়ে উদ্দীপনা জোগায় জনমুখী সংস্কৃতি এবং তার ওপর প্রভুত্ব স্থাপনের জন্য নানামাত্রিক তৎপরতা চালিয়ে যেতে থাকেন ক্ষমতাকাঠামোর ওপরের দিকে থাকা মানুষজন। অনেক আগ থেকেই খেলাটা এ ছকে হয়ে আসছে। আর এ কারণেই ক্ষমতার রূপক নামের ‘শয়তান’ নিচুতলার মানুষের দেহ হয়তো পায়, কিন্তু মন পায় না।
নিম্নবর্গের আয় ও জীবিকা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তার দেহের ওপর ইতিমধ্যেই কর্তৃত্ব স্থাপন করেছে ক্ষমতাসীন। এরপরের ধাপে তার সংস্কৃতি ও মতাদর্শের ওপর প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে তার মনেরও দখল নিতে পারলে নিশ্চিত হয় সর্বৈব ক্ষমতা। আর তাই ‘শয়তান দেহ পাবি, মন পাবি না’—এই উচ্চারণ শ্লীলতার নিরিখে নয়, বরং শ্রেণিসংঘাতের বয়ান হিসেবে পাঠের দাবি রাখে।