অক্টোবরের ১৩ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ৮ হাজার ৫৯৩ কোটি টাকা

ঘোষণার চেয়ে বেশি দামে ডলার কিনতে অনানুষ্ঠানিক পরামর্শ

গাজী আবু বকর : রেমিট্যান্স ধ্বস মোকাবেলায় বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু ব্যাংককে ঘোষণার চেয়ে বেশি দামে ডলার কিনতে অনানুষ্ঠানিক পরামর্শ দেয়ায় চলতি অক্টোবরের প্রথম ১৩ দিনে প্রবাসীরা দেশে বৈধপথে ব্যাংকিং চ্যানেলে ৭৮ কোটি ১২ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতি ডলার ১১০ টাকা হিসাবে ৮ হাজার ৫৯৩ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। গত ৪১ মাসের মধ্যে সেপ্টেম্বরে দেশে বৈধ পথে সর্বনিম্ন প্রবাসী আয় আসে। এ পরিমাণ ছিলো ১৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ডলার। এর আগে সর্বশেষ ২০২০ সালের এপ্রিলে এত কম প্রবাসী আয় দেশে এসেছিল। ওই মাসে প্রবাসী আয় এসেছিল ১০৯ কোটি ডলার। ডলার–সংকটের এ সময়ে প্রবাসী আয় কমে যাওয়ায় ডলার–সংকট আরও প্রকট হয়েছে। রেমিট্যান্স ধ্বসের এই ধারা অব্যাহত থাকায় রিজার্ভেও ধ্বস নেমেছে। বর্তমানে দেশে নিট রিজার্ভ রয়েছে ১৮ বিলিয়ন ডলারের নিচে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু ব্যাংককে ঘোষণার চেয়ে বেশি দামে ডলার কিনতে অনানুষ্ঠানিক পরামর্শ দিয়েছে বলে জানা গেছে। ফলে চলতি মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে প্রবাসী আয় আসা কিছুটা বেড়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, অক্টোবরের প্রথম ১৩ দিনে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংগুলোর মাধ্যমে ৭ কোটি ৬ লাখ ৩০ হাজার ডলার, বিশেষায়িত দুই ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ২ কোটি ৭৩ লাখ ২০ হাজার ডলার। আর বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৬৭ কোটি ৪৭ লাখ ৯০ হাজার ডলার এবং বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৩০ লাখ ৩০ হাজার ডলার। তবে আলোচিত সময়ে কোনো রেমিট্যান্স আসেনি এমন ব্যাংকের সংখ্যা রয়েছে ৮টি। এসব ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বা বিডিবিএল, বিশেষায়িত রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক বা রাকাব। আর বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে- কমিউনিটি ব্যাংক, সিটিজেনস ব্যাংক, সীমান্ত ব্যাংক। বিদেশি খাতের হাবিব ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া এবং উরি ব্যাংক। উল্লেখ্য, রিজার্ভ সংকটের মাঝে রেমিট্যান্স কমাকে ভালো চোখে দেখছেন না খাত সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, গত দুই বছরে কাজের জন্য দেশের বাইরে গেছেন ২০ লাখ প্রবাসী। দেশের বাইরে প্রবাসী বাড়ছে, অথচ দিন দিন কমছে রেমিট্যান্স। এর কারণ খুঁজে সমাধানের দাবি ছিলো তাদের।

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের গত জুলাই মাসে ১৯৭ কোটি ৩০ লাখ ডলারের ১ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। আগস্টে এসেছিল ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ ডলারের প্রবাসী আয়। গত জুন মাসে রেকর্ড পরিমাণ ২১৯ কোটি ৯০ লাখ ডলার ২ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে। একক মাস হিসেবে যা ছিল প্রায় তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আসা প্রবাসী আয়। এর আগে ২০২০ সালের জুলাই মাসে ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ ডলারের রেকর্ড প্রবাসী আয় এসেছিল। খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, ২০২০ সালে হুন্ডি বন্ধ থাকায় ব্যাংকিং চ্যানেলে সর্বোচ্চ সংখ্যক রেমিট্যান্স এসেছিল। বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ২ হাজার ১৬১ কোটি মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স। এটি এ যাবৎকালের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এর আগে করোনাকালীন ২০২০-২১ অর্থবছরে সর্বোচ্চ দুই হাজার ৪৭৭ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে।

দেশে অনেক দিন ধরেই ডলার সংকট চলে আসছে। নানা উদ্যোগেও কোনো কাজ হচ্ছে না। বরং দিন যতো যাচ্ছে, ডলার সংকট আরও তীব্র হচ্ছে। এ সুযোগে ডলার বাণিজ্য করছে অসাধু চক্র। খোলা বাজারে ইচ্ছামতো নেওয়া হচ্ছে দাম। অন্যদিকে সংকট কাটাতে রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে টান পড়েছে রিজার্ভেও। এখন রিজার্ভ কমে ২১ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। যদিও বিশ্লেষকদের ধারণা, আরও কম রয়েছে খরচ করার মতো রিজার্ভ। এরই মধ্যে প্রবাসী আয় রেমিট্যান্সে বড় ধাক্কা লাগে। ৪১ মাসের মধ্যে গত সেপ্টেম্বরে সর্বনিম্ন ১৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ৬০ হাজার ডলার রেমিট্যান্স আসে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক বলেন, ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বাড়াতে হুন্ডি প্রতিরোধসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বাজারে তারল্য বাড়াতে এক্সপোর্ট রিটেনশন কোটা (ইআরকিউ) হিসাবের ৫০ শতাংশ নগদায়নের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তুলনামূলক কম প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এসব উদ্যোগের ফলে ডলার বাজার দ্রুত ঠিক হয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক গত ১৩ জুলাই থেকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিপিএম৬ ম্যানুয়াল অনুযায়ী গ্রস বা মোট রিজার্ভের হিসাব করছে। আইএমএফের পদ্ধতি অনুযায়ী গত বৃহস্পতিবার গ্রস রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন ডলার। আগস্টের চেয়ে সেপ্টেম্বরে রিজার্ভ ২ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার কমে ২১ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। জুনের চেয়ে জুলাইয়ে কমেছিল ১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার। জুলাইয়ের চেয়ে আগস্টে কমেছিল ১ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার।
আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্তের আলোকে সেপ্টেম্বর শেষে নিট রিজার্ভ ২৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার কথা। তবে গ্রস রিজার্ভের চেয়ে নিট রিজার্ভ আরও ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি কম। এর মানে, বর্তমানে নিট রিজার্ভ রয়েছে ১৮ বিলিয়ন ডলারের নিচে। আগামী ডিসেম্বরে রিজার্ভ ২৬ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। যা পরিপালন সম্ভব হবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে আগামি নভেম্বর মাসে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন শর্ত যাচাইয়ে আইএমএফের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের নেতৃত্বে একটি দল বর্তমানে মরক্কোতে আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভায় যোগ দিয়েছেন। সেখানে এ বিষয়টি নমনীয়ভাবে দেখার অনুরোধ করা হবে। দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের বিষয়টি সংস্থাটির পরিচালনা পর্ষদে আলোচনা করে ঠিক হবে। কোনো কারণে আইএমএফের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় না হলে অন্য সবাই ঋণ দেওয়ায় আরও কঠোর হবে। তাতে রিজার্ভের ঝুঁকিপূর্ণ পতন ঠেকানো কঠিন হবে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বর্তমান নিট রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী, একটি দেশের ছয় মাসের বেশি আমদানি দায় মেটানোর অর্থ থাকাকে অধিক নিরাপদ বিবেচনা করা হয়। আর রিজার্ভে তিন মাসের কম আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো অর্থ থাকলে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। দুই বছর আগে ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভ ছিল ৮ মাসের বেশি আমদানি ব্যয় মেটানোর সমান।

রিজার্ভ পরিস্থিতির এমন প্রেক্ষাপটে চলতি মাসের শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠকে অনানুষ্ঠানিকভাবে যে দামেই হোক বেশি প্রবাসী আয় আনার কথা বলে। এরপর কোনো কোনো ব্যাংক ১১৪ টাকার চেয়েও বেশি দামে প্রবাসী আয় এনেছে। এরপর সেই পরামর্শ পরিবর্তন করে জানায়, প্রতি ডলারে সর্বোচ্চ আড়াই টাকা বেশি দাম দেওয়া যাবে। ফলে এখন প্রায় এক ডজন ব্যাংক প্রবাসী আয়ে প্রতি ডলারের দাম দিচ্ছে সর্বোচ্চ ১১২ টাকা ৫০ পয়সা। বাংলাদেশ ব্যাংক বেশি দামে ডলার কিনতে এমন সব ব্যাংককে অনানুষ্ঠানিক নির্দেশনা দিয়েছে, যাদের মাধ্যমে আগে থেকেই ভালো পরিমাণে প্রবাসী আয় দেশে আসছিল। কিন্তু পরে ডলারের দাম বেঁধে দিয়ে তা মানতে বাধ্য করার কারণে এসব ব্যাংকের মাধ্যমে প্রবাসী আয় আসা কমে যায়। এসব ব্যাংকের মধ্যে ইসলামি ধারার পাশাপাশি প্রচলিত ধারার ভালো কয়েকটি ব্যাংকও রয়েছে। তাদের পরামর্শমতো ডলার কেনা হচ্ছে কি না, তারও তদারকি করছেন নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির কিছু কর্মকর্তা। ফলে ব্যাংকগুলোতে একটি অনানুষ্ঠানিক ডলারের বাজার তৈরি হয়েছে। বেশি দামে প্রবাসী আয় সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন ব্যাংকের পক্ষ থেকে কিছু কর্মকর্তাকে এসব কাজে যুক্ত করা হয়েছে। এতে ব্যাংকগুলোতে সুশাসনের চর্চা ব্যাহত হচ্ছে। কারণ, অনানুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করাতে হচ্ছে এসব কর্মকর্তা দিয়ে।

উল্লেখ্য, ঘোষণার চেয়ে বেশি দামে ডলার কেনাবেচার অভিযোগে চলতি মাসের শুরুতে বেসরকারি ওই ১০ ব্যাংকের ১০ জন ট্রেজারিপ্রধানকে ১ লাখ টাকা করে জরিমানা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই টাকা জমা দেওয়ার শেষ সময় ছিল গত সোমবার। তবে এসব ব্যাংকের কর্মকর্তারা জরিমানার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আপিল করেছেন। এখন এ আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান গভর্নর নিজেই। যে ১০ ব্যাংকের ট্রেজারিপ্রধানদের জরিমানা করা হয়, সেগুলো হলো মার্কেন্টাইল ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, মধুমতি ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক ও ট্রাস্ট ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা পাওয়া দুটি ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক বেশি দামে ডলার কেনার জন্য বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তাদের জরিমানা করেছে, এখন তারাই আবার ঘোষণার চেয়ে বেশি দামে ডলার কেনার জন্য পরামর্শ দিচ্ছে।

Share