আইএমএফ এর শর্তানুযায়ী ঘোষিত হলো নতুন মুদ্রানীতি

গাজী আবু বকর : আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর শর্তানুযায়ী ঘোষিত হলো নতুন মুদ্রানীতি। এই নীতির ফলে রিজার্ভ নেমে যাবে ২০ বিলিয়নের ঘরে। কারণ নতুন নীতিমালানুযায়ী দেশের প্রকাশ করা রিজার্ভ থেকে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ ও রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) ছাড়াও এক বছরের বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধের সমপরিমাণ অর্থ বাদ দিতে হবে। ফলে বেরিয়ে আসবে নিট রিজার্ভ। ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন বা বিপিএম-৬ ফর্মুলা বাস্তবায়নের শর্ত ছিলো আইএমএফ এর। এই ফর্মুলা বাস্তবায়নের পাশা পাশি টাকার মান বাড়াতে ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে অর্থ সরবরাহ কমাবে। নতুন মুদ্রানীতিতে ঋণের সুদহারের ৯ শতাংশ ক্যাপ তুলে দিয়ে নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে। অর্থাৎ ‘স্মার্ট’ এভারেজ রেট হলো নতুন সুদহার ব্যবস্থায়।
আইএমএফের ৪ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার ঋণের অন্যতম শর্ত ছিল, নিট রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করা। এক্ষেত্রে মানতে হবে ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন বা বিপিএম-৬ ফর্মুলা। এটি পুরোপুরি মানতে গেলে নিট রিজার্ভ নেমে যাবে ২০ বিলিয়নের ঘরে। কারণ, দেশের প্রকাশ করা রিজার্ভ থেকে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ ও রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) ছাড়াও এক বছরের বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধের সমপরিমাণ অর্থ বাদ দিলে পাওয়া যাবে নিট রিজার্ভ। বর্তমানে রিজার্ভ থেকে ৬ বিলিয়ন ডলার রয়েছে ইডিএফ ও বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ। এগুলোসহ মোট রিজার্ভ এখন ২৯ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার। বিনিয়োগ করা ৬ বিলিয়ন ডলার বাদ দিলে নিট রিজার্ভ দাঁড়াবে ২৩ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স হলে গতকাল রোববার ২০২৩-২৪ অর্থবছরের (জুলাই-ডিসেম্বর) ১ম ৬ মাসের জন্য নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. হাবিবুর রহমান পাওয়ার পয়েন্টের মাধ্যমে নতুন মুদ্রানীতি তুলে ধরেন।

গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার জানান, বিশ্বব্যাপী বর্তমানে চার ধরনের লক্ষ্যমাত্রাভিত্তিক মুদ্রানীতি প্রচলিত আছে। সুদহার, মূল্যস্ফীতি, মুদ্রা সরবরাহ এবং বিনিময় হার টার্গেটিং। বাংলাদেশ ব্যাংক এতদিন ‘মূল্যস্ফীতি টার্গেটিং’ মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে আসছিল। এবার ‘সুদহার টার্গেটিং’ মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। মুদ্রানীতিতে এটা কাঠামোগত পরিবর্তন বলা যায়। গভর্নর বলেন, নতুন মুদ্রানীতিতে টাকার চাহিদা কমাতে নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে। ঋণের সুদহারের যে ৯ শতাংশ ক্যাপ ছিল তাও তুলে দেওয়া হয়েছে। নতুন সুদহার ব্যবস্থা হলো ‘স্মার্ট’ তথা শর্ট টার্ম মুভিং এভারেজ রেট। ১৮২ দিন মেয়াদি সরকারি ট্রেজারি বিলের ৬ মাসের গড় সুদের সঙ্গে আপাতত সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ করিডোর বা সীমা দেওয়া থাকবে। বর্তমানে ট্রেজারি বিলের গড় সুদহার ৭ শতাংশের নিচে রয়েছে। এর মানে গ্রাহক পর্যায়ে ঋণের সুদহার হবে ১০ দশমিক ১০ শতাংশের আশপাশে। নতুন মুদ্রানীতিতে নীতি হার হিসাবে বিবেচিত রেপো সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। অর্থাৎ এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো জরুরি প্রয়োজনে অর্থ নিলে গুণতে হবে অতিরিক্ত সুদ। পাশাপাশি রিভার্স রেপো ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৪ শতাংশ ২৫ শতাংশ থেকে ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে টাকা রাখলে ব্যাংকগুলো আগের চেয়ে বেশি সুদ পাবে। নীতি সুদহার ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের সুদহারের করিডর প্রথা চালু হচ্ছে। এখন স্পেশাল রেপোকে বলা হবে স্ট্যান্ডার্ড ল্যান্ডিং ফ্যাসিলিটি (এসএলএফ), নীতি সুদ ও রিভার্স রোপোকে বলা হবে স্ট্যান্ডার্ড ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ)। এক প্রশ্নের জবাবে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, আমরা রিজার্ভ থেকে যেসব বিনিয়োগ করেছি সেগুলো ঝুঁকিমুক্ত। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আমাদের সব ঋণের গ্যারান্টার রয়েছে। সব টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক ফেরত পাবে। শ্রীলংকার লোনও তাদের স্থানীয় মুদ্রায় সমন্বয়ের মাধ্যমে আমরা ফেরৎ পেতে পারি।

মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১১ দশমিক ১০ শতাংশ। এর আগের মুদ্রানীতিতে প্রাক্কলন করেছিল ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ। যদিও প্রাক্কলিত হারের চেয়ে লক্ষ্যমাত্রার অর্জন ছিল অনেক কম। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষে তথ্যানুযায়ী, গত এপ্রিলে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশে নেমেছে। অন্যদিকে সরকারি ঋণের ৪৩ দশমিক ৩০ শতাংশ। আগের মুদ্রানীতিতে প্রাক্কলন ছিল ৩৭ দশমিক ৭০ শতাংশ।

আগামী অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ এবং সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবার প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনের চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে জোর দিয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সবশেষ তথ্য বলছে, চলতি বছরের মে মাসে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ হয়েছে। যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। এছাড়া মে মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৪০ বেসিস পয়েট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে। এপ্রিলে তা ছিল ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ। অন্যদিকে, পয়েন্ট টু পয়েন্ট খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতিও এপ্রিলে ৯.৭২ শতাংশ পয়েন্ট থেকে বেড়ে মে মাসে ৯.৯৬ শতাংশ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামাল, কাজী ছাইদুর রহমান, আবু ফরাহ মো. নাছের, এ কে এম সাজেদুর রহমান খান, বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বাস, প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. হাবিবুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র আবুল বশর সহ গবেষণা বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

Share