ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকট যে সংঘাতের গল্পের শেষটা অজানা, অন্ধকার

নয়াবার্তা ডেস্ক : বহু বছর ধরেই অমীমাংসিত এক সংঘাতে জড়িয়ে আছে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন। ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে ফিলিস্তিনি নিহতের খবর প্রায়ই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে জায়গা করে নেয়।

তবে ফিলিস্তিনিদের হাতে ইসরায়েলি নিহত হওয়ার খবর তুলনামূলক কমই আসে। এবার পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন।
সর্বশেষ শনিবার ইসরায়েলকে লক্ষ্য বড় আকারের হামলা চালায় ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। বিপরীতে ইসরায়েলও গাজায় হামলা চালিয়েছে। বিবিসি বলছে, হামাসের হামলায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত অন্তত ৩০০ বেসামরিক নিহত হয়েছেন। কয়েকজন ইসরায়েলিকে বন্দিও করা হয়েছে। বিপরীতে গাজায় ইসরায়েলের হামলায় ৩১৩ জন নিহত হয়েছেন। আর আহত হয়েছেন অন্তত দুই হাজার জন আহত হয়েছেন।

ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসের উপপ্রধান সালেহ আল-আরোওরি বলেন, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এখন হামাস সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত রয়েছে। হামাসের হামলা শুরুর কয়েক ঘণ্টা পর ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তার দেশের জনগণের উদ্দেশে বলেন, ইসরায়েলের জনগণ, আমরা যুদ্ধের মধ্যে রয়েছি। আমরা জিতব। শত্রুদের এ জন্য এমন মূল্য দিতে হবে, যে সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই।

এদিকে ইসরায়েলি অবস্থান লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে লেবাননের ইরান-সমর্থিত শিয়াপন্থী গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ। রোববার লেবাননের সামরিক-রাজনৈতিক সংগঠন হিজবুল্লাহর পক্ষ থেকে এই হামলার তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করা হয়েছে। আর
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা পাল্টা হিসেবে কামান দিয়ে দক্ষিণ লেবাননে গোলা ছুড়েছে। এক বিবৃতিতে হামাস বলছে, ইহুদিবাদী শত্রু ইসরায়েল অধিকৃত লেবাননের শেবা খামারের তিনটি অবস্থানে হামলা চালিয়েছে হিজবুল্লাহ। এই হামলায় বিপুলসংখ্যক আর্টিলারি শেল ও গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। এতে তাৎক্ষণিকভাবে হতাহতের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনায় পক্ষে-বিপক্ষে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা-সংগঠন। আরব লিগ গাজায় সামরিক অভিযান দ্রুত বন্ধের দাবি করেছে। লিগের প্রধান দুই পক্ষের সশস্ত্র লড়াইয়ের অবসান চেয়েছেন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বর্তমান সভাপতি ব্রাজিল বলেছে, সহিংসতা বন্ধে তারা পরিষদের দ্রুত সভা আহ্বান করবে। ইসরায়েলের সাধারণ নাগরিকের ওপর ব্যাপকহারে রকেট হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে বেলজিয়াম।

ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট বলছেন, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামাসের সন্ত্রাসী হামলায় আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে নিন্দা জানাই। এ ধরনের ঘৃণ্য হামলার বিরুদ্ধে নিজেদের রক্ষা করার অধিকার ইসরায়েলের আছে। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তারা ‘ইসরায়েলের ওপর হামাসের এই সন্ত্রাসী হামলার’ নিন্দা জানায়। জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ বলেন, তার দেশ হামাসের হামলার নিন্দা জানায় এবং ইসরায়েলের পক্ষে আছে। তবে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, হামাসের এ হামলা ইসরায়েলের দখলদারির বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের আস্থা বাড়াবে। আর সৌদি আরব বলছে, তারা ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে এই সংঘাতের দ্রুত সমাপ্তি চায়। এই ঘটনা তারা পর্যবেক্ষণ করছে।

মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিন নামের যে এলাকা, সেটি ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অধীন। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমানদের পরাজয়ের পর ব্রিটেন ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ নেয়। তখন ফিলিস্তিনে যারা থাকতো তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল আরব, সেই সঙ্গে কিছু ইহুদি, যারা ছিল সংখ্যালঘু। এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে শুরু করলো যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ব্রিটেনকে দায়িত্ব দিল ইহুদি জনগোষ্ঠীর জন্য ফিলিস্তিনে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। ইহুদিরা এই অঞ্চলকে তাদের পূর্বপুরুষদের দেশ বলে দাবি করে। কিন্তু আরবরাও দাবি করে এই ভূমি তাদের এবং ইহুদিদের জন্য সেখানে রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টার তারা বিরোধিতা করে।

১৯২০ থেকে ১৯৪০ দশকের মধ্যে ইউরোপ থেকে দলে দলে ইহুদিরা ফিলিস্তিনে যেতে শুরু করে এবং তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ইউরোপে ইহুদি নিপীড়ন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভয়ংকর ইহুদি নিধনযজ্ঞের পর সেখান থেকে পালিয়ে এরা নতুন এক মাতৃভূমি তৈরির স্বপ্ন দেখছিল। ফিলিস্তিনে তখন ইহুদি আর আরবদের মধ্যে সহিংসতা শুরু হলো, একইসঙ্গে সহিংসতা বাড়ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধেও।

১৯৪৭ সালে জাতিসংঘে এক ভোটাভুটিতে ফিলিস্তিনকে দুই টুকরো করে দুটি পৃথক ইহুদি এবং আরব রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হলো। জেরুজালেম থাকবে একটি আন্তর্জাতিক নগরী হিসেবে। ইহুদি নেতারা এই প্রস্তাব মেনে নেন, কিন্তু আরব নেতারা প্রত্যাখ্যান করেন। জাতিসংঘের এই পরিকল্পনা কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি। ব্রিটিশরা সমস্যার কোনো সমাধান করতে ব্যর্থ হয়ে ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন ছাড়ে। ইহুদি নেতারা এরপর ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। বহু ফিলিস্তিনি এর প্রতিবাদ জানান এবং এরপর যুদ্ধ শুরু হয়। প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর সৈন্যরাও যেখানে যান যুদ্ধ করতে।

হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে তখন হয় তাদের ঘরবাড়ি ফেলে পালাতে হয় অথবা চলে যেতে বাধ্য করা হয়। ফিলিস্তিনিরা এই ঘটনাকে ‘আল নাকবা’ বা ‘মহা-বিপর্যয়’ বলে থাকে। পরের বছর এক যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে যখন যুদ্ধ শেষ হলো , ততদিনে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের বেশিরভাগ অঞ্চল দখল করে নিয়েছে। জর্ডান দখল করেছিল একটি অঞ্চল, যেটি এখন পশ্চিম তীর বলে পরিচিত। আর মিশর দখল করেছিল গাজা। জেরুজালেম নগরী ভাগ হয়ে যায়। ইসরায়েলি বাহিনী দখল করে নগরীর পশ্চিম অংশ, আর জর্ডানের বাহিনী পূর্ব অংশ।

দুপক্ষের মধ্যে যেহেতু কখনোই কোন শান্তি চুক্তি হয়নি, তাই উভয়পক্ষই একে অপরকে দোষারোপ করতে থাকে। দুই পক্ষের মধ্যে পরের দশকগুলোতে এরপর আরও বহু যুদ্ধ হয়েছে। ১৯৬৭ সালে আরেকটি যুদ্ধে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের পূর্ব জেরুজালেম এবং পশ্চিম তীর, সিরিয়ার গোলান মালভূমি, গাজা এবং মিশরের সিনাই অঞ্চল দখল করে নেয়। বেশিরভাগ ফিলিস্তিনি শরণার্থীর বাস গাজা ও পশ্চিম তীরে। প্রতিবেশী জর্ডান, সিরিয়া ও লেবাননেও আছে অনেক ফিলিস্তিনি।

ইসরায়েল এই ফিলিস্তিনি এবং তাদের বংশধরদের কাউকেই আর তাদের বাড়িঘরে ফিরতে দেয়নি। ইসরায়েল বলে থাকে, এদের ফিরতে দিলে সেই চাপ ইসরায়েল নিতে পারবে না এবং ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়বে। ইসরায়েল এখনো পশ্চিম তীর দখল করে আছে। গাজা থেকে তারা যদিও সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছে, জাতিসংঘের দৃষ্টিতে এটি এখনো ইসরায়েলের দখলে থাকা একটি এলাকা।

ইসরায়েল এখন পুরো জেরুজালেম নগরীকেই তাদের রাজধানী বলে দাবি করে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিরা পূর্ব জেরুজালেমকে তাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে চায়। পুরো জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে কেবল যুক্তরাষ্ট্রসহ হাতে গোনা কয়েকটি দেশ। গত ৫০ বছর ধরে ইসরায়েল এসব দখলীকৃত জায়গায় ইহুদি বসতি স্থাপন করে যাচ্ছে। ছয় লাখের বেশি ইহুদি এখন এসব এলাকায় থাকে। ফিলিস্তিনিরা বলছে, আন্তর্জাতিক আইনে এগুলো অবৈধ বসতি এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায়। তবে ইসরায়েল তা মনে করে না।

পূর্ব জেরুজালেম, গাজা ও পশ্চিম তীরে যে ফিলিস্তিনিরা থাকেন, তাদের সঙ্গে ইসরায়েলিদের উত্তেজনা প্রায়শই চরমে উঠে। গাজা শাসন করে কট্টরপন্থী ফিলিস্তিনি দল হামাস। ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের অনেকবার যুদ্ধ হয়েছে। গাজা সীমান্ত কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ইসরায়েল ও মিশর, যাতে হামাসের কাছে কোনো অস্ত্র পৌঁছাতে না পারে। গাজা ও পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরা বলছে, ইসরায়েলের নানা পদক্ষেপ এবং কঠোর বিধিনিষেধের কারণে তারা খুবই দুর্দশার মধ্যে আছে। অন্যদিকে ইসরায়েল দাবি করে যে, ফিলিস্তিনিদের সহিংসতা থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য তাদের এই কাজ করতে হয়।

ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিরা বেশ কিছু ইস্যুতে মোটেই একমত হতে পারছে না। এর মধ্যে আছে- ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের বিষয়ে কী হবে; পশ্চিম তীরে যেসব ইহুদি বসতি স্থাপন করা হয়েছে সেগুলো থাকবে, নাকি সরিয়ে নেওয়া হবে; জেরুজালেম নগরী উভয়ের মধ্যে ভাগাভাগি হবে কি না; আর সবচেয়ে জটিল ইস্যু হলো- ইসরায়েলের পাশাপাশি একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্ন। গত ২৫ বছর ধরেই শান্তি আলোচনা চলছে থেমে থেমে। কিন্তু সংঘাতের কোনো সমাধান এখনো মেলেনি।

ভবিষ্যৎ তাহলে কী? এক কথায় বলতে গেলে, খুব সহসা এই পরিস্থিতির কোনো সমাধান মিলবে না। সংকট সমাধানের সর্ব-সাম্প্রতিক উদ্যোগটি নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এটিকে ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি বলে বর্ণনা করেছিলেন। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা এই উদ্যোগকে নাকচ করে দিয়েছিল একেবারেই একতরফা একটি উদ্যোগ বলে। যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্যোগ নিয়ে আসলে কাজ মোটেই এগোয়নি। ভবিষ্যতের যেকোনো শান্তি চুক্তির আগে দুপক্ষকে জটিল সব সমস্যার সমাধানে একমত হতে হবে। সেটি যতদিন না হচ্ছে, দুপক্ষের এই সংঘাত চলতেই থাকবে।

দীর্ঘদিন ধরে চলমান ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের সংকট নিরসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্তই ছিল দুই পক্ষের জন্য আলাদা দুটি দেশ। আর এই দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের তত্ত্বটি এসেছিলো ১৯৯৩ সালে অসলো শান্তি আলোচনার মাধ্যমে। দুপক্ষই তাতে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতি এখন অনেকটাই বদলে গেছে। ইসরায়েলের সঙ্গে বৈরি সম্পর্ক ছিল এমন কয়েকটি মুসলিম দেশ এখন ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি করেছে।

Share