গাজী আবু বকর : সদ্য ক্ষমতাচ্যুৎ সরকারের আস্থাভাজন প্রভাবশালী আমলারা রাতা রাতি জার্সি বদলে ফেলেছেন। এসব জার্সি বদল আমলারা নিজেদেরকে জনবান্ধব প্রমাণের ম্যরাথন প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বুঝাচ্ছেন যে, তাঁরা ক্ষমতাসীন সরকারের হুকুম পালনে বাধ্য ছিলেন। অনৈতিক কোনো কাজের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা নেই। বর্তমান সরকারের নির্দেশিত কাজও তাঁরা সূচারুভাবে করতে তৎপর থাকবেন।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জন-গণঅভ্যূত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৬ আগস্ট সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদ থমকে গেছে। এর পরও অভ্যুত্থানে বিদায়ি সরকারের মদদপুষ্ট আমলাদের দৌরাত্ম্য কমেনি। বরং কয়েক দিন চুপ থাকার পর তৎপরতা বাড়ানো শুরু করে। এতে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয় ও এর বাইরে পদবঞ্চিতদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ অব্যাহত রাখতে দেখা যায়। নানা অভিযোগের পরও প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা সভা-সমাবেশ ও দাপ্তরিক কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। উপদেষ্টারা বোঝার চেষ্টা করছেন, দল অন্ধ আমলারা কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারেন। এতে বঞ্চিত অনেকের মধ্যে দিন দিন বাড়ছিল হতাশা। তবে কয়েক দিন পর্যবেক্ষণের পর গত বুধবার একযোগে ১০ জন সচিবের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এতেই বড় নড়াচড়া পড়ে শীর্ষ পদের কর্মকর্তাদের মধ্যে। এরপরও মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ ৯ জন সচিব চুক্তিভিত্তিক দায়িত্ব পালন করছেন। এর বাইরে বিসিএস ১৩ ব্যাচের কর্মকর্তা ও জননিরাপত্তা সচিব জাহাংগীর আলমকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়; এতে কিছু স্বস্তি ফেরে প্রশাসন ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন শিবিরে। কারণ তিনি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একক কর্তৃত্ব দেখিয়ে নৌকার বিজয় নিশ্চিত করেন। এই কৃতকর্মের জন্য তাকে পুরস্কারস্বরূপ জননিরাপত্তা সচিব করে সরকার। এতে বিদায়ি সরকারের আমলাদের খোলস বদলে সাধু সাজার যে কৌশল চলছিল, তাতে কিছুটা ছেদ পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন প্রশাসনের একাধিক আমলা।
বিসিএস ১৩ ব্যাচের একজন কর্মকর্তাকে ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কালিমা দিয়ে সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে আর পদোন্নতি দেয়নি বিদায়ি সরকার। এ ধরনের কয়েকজন বঞ্চিত আমলা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বর্তমান প্রশাসনের শীর্ষ আমলারা নিজেদের নিরপেক্ষ প্রমাণে মরিয়া। অনেকেই ভালো মন্ত্রণালয়ের সচিব হওয়ার জন্য তৎপর। কেউ হতে চাইছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং কেউ মুখ্য সচিব।
প্রশাসনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য খুবই বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোস্তফা কামাল, স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান, ধর্ম সচিব মো. হামিদ জমাদ্দার এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সচিব আজিজুর রহমান। এসব আমলা বর্তমানে খোলস বদলে পদ ধরে রাখতে মরিয়া। তবে এসব সচিব না, অন্য মন্ত্রণালয়ের সচিবরাও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে আস্থাভাজন হয়ে উঠার চেষ্টা চালাচ্ছেন। এজন্য প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্য উপদেষ্টাদের বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনদের মাধ্যমে কেউ কেউ কাছে পৌঁছানোর মাধ্যম খুঁজছেন বলেও খবর রটেছে। এদিকে, প্রশাসনে চাওর হয়েছে, চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া জাহাংগীর আলম থেকে জননিরাপত্তা বিভাগ রাহুমুক্ত হলেও যাকে ওই পদে পদায়ন করা হয়েছে, তিনিও বিদায়ি সরকারের ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন ছিলেন। বর্তমান অন্তর্র্বতীকালীন সরকার পুলিশে যে সংস্কার ও শুদ্ধি অভিযান চালাতে চাচ্ছে, এই কর্মকর্তা থাকলে সেটা ভেস্তে যেতে পারে বলে ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে। কারণ তার বিষয়ে ওই সরকারের অনেক সচিব কোণঠাসা। এদের মধ্যে বিসিএস ১১ ব্যাচের কর্মকর্তা রয়েছেন বলেও জনপ্রশাসন সূত্রে জানা গেছে। সরকারের অনেক অনৈতিক কাজে তারা ব্যবহৃত না হওয়ায় সাইড লাইনে ফেলে রাখা হয়েছে।
অন্যদিকে, মাঠ প্রশাসনের দলবাজ কর্মকর্তা জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপার (এসপি) পদেও রদবদল আসছে। তাদের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনে সরকারকে নগ্নভাবে সহায়তা করার অভিযোগ উঠেছে। এমনকি বিদায়ি সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার জন্য কোনো কোনো জেলায় তারা বিশৃঙ্খলা করছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
জনপ্রশাসনের প্রাপ্ত তথ্য মতে, আগামী সপ্তাহে বঞ্চিত ও নানাভাবে হয়রানির শিকার হওয়া এক ডজনের মতো কর্মকর্তা সচিব পদে পদোন্নতি পেতে পারেন বলে জানা গেছে। এর মধ্যে ১১ ব্যাচের চার থেকে পাঁচজন, ১৩ ব্যাচের হাফডজন এবং ১৫ ব্যাচের কয়েকজন কর্মকর্তা রয়েছে। যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে পদোন্নতি ও বিগত সরকারের বিরাগভাজন হওয়া কর্মকর্তাদের সচিব পদে পদোন্নতি দিতেই এই সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। সরকারের আস্থাভাজন প্রজাতন্ত্রের শীর্ষ কর্মকর্তা নিয়োগ না থাকার কারণে প্রশাসনিক ও স্পর্শকাতর অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়ায় ধীরে চলো নীতিতে এগোচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ত্যাগী ও নির্ভীক কর্মকর্তাদের উপযুক্ত পদে পদায়ন করার পর পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা সরকারের সাজানো প্রশাসন বলয়মুক্ত হবে এমন আভাস দেওয়া হয়েছে নীতিনির্ধারণী মহল থেকে।