নয়াবার্তা প্রতিবেদক : আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহে ভাটা পড়েছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশে। যা ২৩ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত জুনের শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ৯৪ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা। তখন আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ঋণে প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ। এরপর জুলাইয়ে ঋণ কমে ১৪ লাখ ৮৫ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকায় নামে। তাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কমে হয় ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ। বর্তমান মুদ্রানীতিতে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১০ দশমিক ৯০ শতাংশ। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেশ কয়েক মাস ধরেই চাপে আছে দেশের অর্থনীতি। পাশা পাশি শুরু হয় রাজনৈতিক সংকট। তাই ব্যাংকগুলো ঋণ কম দেওয়ার কৌশল নিয়েছে এবং ব্যবসায়ীরাও কম ঋণ নিচ্ছেন। ফলে, সাম্প্রতিক সময়ে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি বেশ কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত জুলাই মাসে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ২০২১ সালের অক্টোবরের পর চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে এই হার সর্বনিম্নে নেমেছে। ২০২১ সালের অক্টোবরে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ। সেপ্টেম্বরের এই প্রবৃদ্ধি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত ১০ দশমিক ৯০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ দশমিক ২১ শতাংশ কম। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে, চলতি অর্থবছর শেষে অর্থাৎ আগামী জুনে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ১১ শতাংশে দাঁড়াবে। এদিকে জুলাই থেকে নতুন পদ্ধতিতে ঋণের সুদহার নির্ধারিত হচ্ছে। যা স্মার্ট বা সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল হিসেবে পরিচিত। প্রতি মাসের শুরুতে এই হার জানিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জুলাইয়ে স্মার্ট রেট ছিল ৭ দশমিক ১০ শতাংশ, যা আগস্টে বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ। ফলে ব্যাংকঋণের সুদহার বেড়ে হয়েছে ১০ দশমিক ১৪ শতাংশ। আগে ব্যাংকঋণের সুদহার ছিল সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ। সুদ বৃদ্ধির ফলে ঋণের চাহিদা কিছুটা কমেছে। এছাড়া, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখতে সাশ্রয়ী উদ্যোগের কারণে আমদানি খরচ কমেছে। ফলে এ খাতে ঋণের চাহিদাও কমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, আকাশছোঁয়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদ হার বাড়ানোয় আগামী মাসগুলোতে ঋণ প্রবৃদ্ধি আরও কমবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত মাসে নীতি সুদ হার ৭৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ করেছে। সেপ্টেম্বরে গড় মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। যা চলতি অর্থবছরের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ৬ শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে রেকর্ড পরিমাণ খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা ক্রমাগত কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। পাশা পাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া বিশেষ নীতি সুবিধার কারণে ঋণ পুনঃতফসিলের পাহাড় তৈরি হয়েছে। দেশের ব্যাংকখাতে পুনঃতফসিল করা ঋণের স্থিতি এখন ২ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। যা মূলত খেলাপির তালিকা থেকে কেটে এনে পুনঃতফসিলের তালিকায় সংযোজন করা হয়েছে। অন্যদিকে, সরকারি-বেসরকারি প্রায় ১৫টি ব্যাংক তারল্যসংকটে পড়েছে। তাঁরা দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছেন। এরপরও কেউ কেউ আগ্রাসীভাবে ঋণ দিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি ইসলামি ধারার কয়েকটি ব্যাংক চাহিদামতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে তারল্য জমা রাখতে না পারায় তাদের নিয়মিত জরিমানা গুনতে হচ্ছে। এর বিপরীতে যেসব ব্যাংকের টাকা রয়েছে, তারা ঋণের ব্যাপারে বেশ সতর্ক। পরিস্থিতি না বুঝে তারা ঋণ ছাড় করছে না। এর ফলে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। উল্লেখ্য, দেশে দেড় বছর ধরে ডলারের সংকট চলছে। এতে ডলারের দাম ৮৫ থেকে বেড়ে ১১১ টাকা ৫০ পয়সায় উঠেছে। মাঝে ডলারের দাম বাড়ার কারণেও বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমেছে। কারণ, প্রতি ডলারে খরচ ২৫ টাকার বেশি বেড়ে গিয়েছিল। এখন আমদানি ঋণ কমে যাওয়ায় বেসরকারি ঋণ কমে গেছে।