জেলহত্যা দিবস বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অবিচল ছিলেন সৈয়দ নজরুল

নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন একজন নির্লোভ, দেশপ্রেমিক ও আত্মত্যাগী নেতা। আমৃত্যু তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্বস্ত সহচর ছিলেন, অবিচল ছিলেন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন ক্ষমতাসীন খুনি মোশতাক চক্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ না করায় কারাজীবন বেছে নিতে হয় সৈয়দ নজরুলকে। আরও তিন সতীর্থর সঙ্গে ৩ নভেম্বর জেলহত্যার শিকার হন তিনি।

নির্মম সে হত্যাকাণ্ডের সময়কার দুঃসহ নানা স্মৃতির কথা বলেছেন শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলামের মেয়ে কিশোরগঞ্জ-১ (সদর-হোসেনপুর) আসনের সংসদ সদস্য ডা. সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি। পুতুল খেলার বয়সে বাবার মর্মান্তিক মৃত্যু ও শূন্যতা সবসময় কাঁদায় তাকে, বাবার আত্মত্যাগের সেই স্মৃতি ভাসে চোখের সামনে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সৈয়দ নজরুলের বাসায় ফোন করেছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। সৈয়দ নজরুল ফোনটি রিসিভ করেন। দু’এক মুহূর্ত তিনি চুপ করে শোনেন। মোশতাক তাকে লোভ এবং ভয় দেখাতে চেষ্টা করেন রিসিভারের অপর প্রান্ত থেকে। শান্ত স্বভাবের সৈয়দ নজরুল ‘বেইমান’ বলে হুংকার দিয়ে প্রচণ্ড রাগে কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে পড়েন এবং টেলিফোনটাকে সজোরে আছড়ে ফেলেন। এরপরও একাধিকবার ফোন করেছিলেন মোশতাক। সৈয়দ নজরুলের স্ত্রী সৈয়দা নাফিসা ইসলাম ফোন রিসিভ করলে চাইতেন সৈয়দ নজরুলকে। কিন্তু মোশতাকের ফোনই ধরেননি সৈয়দ নজরুল। নাফিসা ইসলামকে ফোনে তখন মোশতাক বলেছিলেন, ‘আশরাফের (সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম) বাপের তো ভয়াবহ পরিণতি হবে। আপনি তাকে বলেন আমার সাথে যেতে। তিনি যা পেতে চান, সব সুযোগ-সুবিধা আমি দেব।’

নাফিসা ইসলামও খন্দকার মোশতাকের প্রলোভন-হুমকি উপেক্ষা করেন। মোশতাকের ফোন ও প্রলোভনের কথা সৈয়দ নজরুলকে জানানোর পর তিনি স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘যারা বঙ্গবন্ধুসহ পুরো পরিবারকে মেরে ফেলেছে তাদের সাথে কোনো কথা হতে পারে না। আমি বঙ্গবন্ধুর রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না।’ খন্দকার মোশতাকের ডাক উপেক্ষা করায় ২৩ আগস্ট গ্রেপ্তার করা হয় সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ জাতীয় চার নেতাকে। জেলখানায়ও অনেক প্রলোভন দেখানো হয়, দেওয়া হয় হত্যার হুমকি। কিন্তু শত প্রলোভনেও মাথানত করেননি তিনি।

বাকরুদ্ধ কণ্ঠে সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি এমপি জানান, ওই সময় তিনি পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন। জাতীয় চার নেতাসহ সৈয়দ নজরুলকে যখন গ্রেপ্তার করা হয়, তখন সৈয়দা নাফিসা ইসলাম সরকারি বাসভবন ছেড়ে গোপীবাগে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে সেখানে ওঠেন। সেই বাসায় মায়ের আঁচল ঘিরে থাকতেন অবুঝ তিন ভাইবোন সৈয়দ শরীফুল ইসলাম, জাকিয়া নূর লিপি ও সৈয়দা রাফিয়া নূর রূপা। এরই মধ্যে ৩ নভেম্বর ঘটে মর্মন্তুদ জেলহত্যার ঘটনা। তখন সৈয়দ নজরুলের চার ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও ছোট ছেলে সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম দেশের বাইরে এবং সৈয়দ শাফায়েতুল ইসলাম বিএমএর ট্রেনিংয়ে চট্টগ্রামে ছিলেন। অবুঝ ছেলে শরীফুলকে নিয়ে নাফিসা ইসলাম ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যান সৈয়দ নজরুলের লাশ আনতে। কিন্তু শরীফুল প্রাপ্ত বয়স্ক না হওয়ায় লাশ শনাক্ত করতে দেয়নি কারা কর্তৃপক্ষ। পরে নাফিসা ইসলামের ভাই আসাদুজ্জামান গিয়ে লাশ শনাক্ত করেন।

জাকিয়া নূর লিপি বলেন, বাবা নৃশংস হত্যার শিকার হওয়ার পর মা আমাদের নিয়ে পাথরচাপা কষ্টে শোক সামলেছেন। সে সময় আমাদের সমবেদনা জানানোর মতোও কেউ ছিল না। মায়ের নিরন্তর সংগ্রামের কারণে আমরা আজ এই পর্যায়ে আসতে পেরেছি।

সৈয়দ নজরুল ইসলামের জন্ম কিশোরগঞ্জ শহরের তিন কিলোমিটার পূর্বে যশোদল ইউনিয়নের বীরদামপাড়া গ্রামে ১৯২৫ সালে। তার বাবার নাম সৈয়দ আব্দুর রইস এবং মা সৈয়দা নূরুন্নাহার খাতুন। ১৯৪৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে এমএ এবং ১৯৫৩ সালে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রজীবনেই রাজনীতি ও দেশ সেবার মন্ত্রে উজ্জীবিত হন তিনি।

Share