ঢাকায় মধ্যরাতে ডাকাতি করতে গিয়ে তিন পুলিশ কারাগারে

নয়াবার্তা প্রতিবেদক : বিদেশফেরত ব্যক্তিদের মালামাল লুটে নিতে মধ্যরাতে ঢাকার বিমানবন্দরের সামনের সড়কে মাইক্রোবাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন একদল ডাকাত। এ খবর শুনে ঘটনাস্থলে গিয়ে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের কাছ থেকে একটি হাতকড়া উদ্ধার করা হয়। পরে জানা যায়, তাঁরা পুলিশের কনস্টেবল। মিরপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্টে (পিওএম) দায়িত্বরত। জিজ্ঞাসাবাদে ডাকাতির উদ্দেশ্যে সেখানে অবস্থান নেওয়ার কথা স্বীকার করেন তাঁরা। একজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন।

এই তিন পুলিশ সদস্য হলেন রবিউল ব্যাপারী (২৭), মো. আজাদ (২৪) ও উজ্জ্বল চন্দ্র বর্মণ (২৫)। তিনজনই এখন কারাগারে আছেন। রবিউলের বাড়ি মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার নরারকান্দি গ্রামে, আজাদের বাড়ি দিনাজপুরের মহাদেবপুর গ্রামে আর উজ্জ্বলের বাড়ি লালমনিরহাটের মধুরাম গ্রামে।

১ এপ্রিল রাত ১২টার দিকে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পুলিশ বক্সের সামনের সড়ক থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। ওই অভিযানে থাকা বিমানবন্দর থানার পরিদর্শক (অপারেশন) শফিকুল ইসলাম বলেন, ওই রাতে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে তিন কনস্টেবলকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা স্বীকার করেছেন, সংঘবদ্ধ ডাকাত চক্রের সঙ্গে তাঁদের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। ডাকাতির উদ্দেশ্যেই সেদিন তাঁরা সেখানে অবস্থান করেছিলেন।

তিন পুলিশ কনস্টেবলের মধ্যে উজ্জ্বল চন্দ্র বর্মণের কাছ থেকে একটি হাতকড়া জব্দ করা হয় বলে পুলিশের বিমানবন্দর জোনের সহকারী কমিশনার আসমা আক্তার সোনিয়া জানান। এ ঘটনায় ওই রাতেই (২ এপ্রিল প্রথম প্রহরে) তিন পুলিশ কনস্টেবলসহ নয়জনের নাম উল্লেখ করে বিমানবন্দর থানায় মামলা করেন ওই থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আহসান উল্লাহ। মামলার জব্দ তালিকায় একটি হাতকড়া ছাড়াও একটি লেজার লাইটের উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়া তিন আসামির মুঠোফোন জব্দ করা হয়েছে।

মামলার বাদী এসআই আহসান উল্লাহ বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ঘটনাস্থলে হাজির হওয়ার পর একটি মাইক্রোবাস দেখতে পান। তখন গাড়িতে অবস্থান করছিলেন কয়েকজন। আর বাকিরা দাঁড়িয়ে ছিলেন। পুলিশের গাড়ি আসার পর গাড়িতে থাকা ডাকাত দলের সদস্যরা ঘটনাস্থল থেকে দ্রুত পালিয়ে যান। তিনজনকে গ্রেপ্তার করার পর জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেন, তাঁরা পুলিশের কনস্টেবল।

মামলায় নীলফামারীর আবদুর রাজ্জাক (২৬), মাদারীপুরের প্রদীপ বালা (২৪), গোপালগঞ্জের লিংকন মণ্ডলকে (৩৩) আসামি করা হয়েছে। অপর তিন আসামি মিন্টু (৩০), বিচিত্র (৩৭) ও জীবনের (৪২) নাম–ঠিকানা জানা যায়নি। গত সোমবার পুলিশের তিন কনস্টেবলকে আদালতে তুলে ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করে বিমানবন্দর থানা–পুলিশ। রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, গ্রেপ্তার তিন আসামি ও পলাতক আসামিরা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের যানবহনের গতি রোধ করে তাঁদের সঙ্গে থাকা মূল্যবান স্বর্ণালংকার ও মালামাল ডাকাতি করে আসছেন। তাঁরা আন্তজেলা ডাকাত দলের সদস্য।

তবে গ্রেপ্তার তিন পুলিশ সদস্যের আইনজীবী সুলতানা আক্তার বলেন, পুলিশের কনস্টেবল পদে কর্মরত তাঁর তিন মক্কেলের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনতে ব্যর্থ হয়েছে পুলিশ। ডাকাতির প্রস্তুতির মামলা দেওয়া হলেও কোনো ধরনের অস্ত্র জব্দ করা হয়নি। হয়রানির জন্য এই মামলা দেওয়া হয়েছে বলে আদালতের কাছে দাবি করেন আইনজীবী সুলতানা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিমানবন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজিজুল হক মিঞা বলেন, গ্রেপ্তার তিন কনস্টেবলের মধ্যে উজ্জ্বল চন্দ্র বর্মণকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তিনি ডাকাতির প্রস্তুতি নেওয়ার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। তিনজন পুলিশ সদস্য হয়েও কেন ডাকাত দলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন, সেটি খুঁজে বের করা হচ্ছে। তাঁদের এর আগে অপরাধে সংশ্লিষ্টতার রেকর্ড আছে কি না, সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

ওই তিন কনস্টেবলের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে ডিএমপির পিওএম বিভাগের (পশ্চিম) উপকমিশনার মোমতাজুল এহসান আহাম্মদ হ‌ুমায়ূন এবং পিএমও (উত্তর) বিভাগের উপকমিশনার জসিম উদ্দিন জানিয়েছেন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পুলিশ সদস্যদের অনেকে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন। আদালত সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২০২১ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত বিগত ৯ বছরে পুলিশ বাহিনীর ১১৬ জন সদস্যের বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানা ও ঢাকার বিভিন্ন আদালতে ফৌজদারি মামলা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে মাদক, ডাকাতি, অপহরণ, চাঁদাবাজি ও ধর্ষণের মতো অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে মাদক সংশ্লিষ্ট অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ রয়েছে অনেকের বিরুদ্ধে।

মামলার নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ফৌজদারি মামলার আসামি হওয়া ১১৬ জনের মধ্যে ডিএমপির উপপরিদর্শক (এসআই) পদমর্যাদার কর্মকর্তা আছেন ১৯ জন, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মর্যাদার ১৬ জন। এ ছাড়া ৭৪ জন পুলিশ কনস্টেবল, ৫ জন নায়েক ও ১ জন সার্জেন্টের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হয়েছে।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১১৬ জনের মধ্যে মাদক মামলার আসামি ২৮ জন। এর বাইরে ৯ জনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, ৬ জনের বিরুদ্ধে ছিনতাই, ৫ জনের বিরুদ্ধে পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন, ৩ জনের বিরুদ্ধে হত্যা, ১২ জনের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, ৪ জনের বিরুদ্ধে অপহরণ ও ১৮ জনের বিরুদ্ধে পারিবারিক বিরোধ ও নারী নির্যাতনের মামলা হয়েছে।

পুলিশের সদস্য হয়ে গুরুতর ফৌজদারি অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাকে উদ্বেগজনক বলছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হয়ে ফৌজদারি অপরাধে যাঁরা জড়িয়েছেন, তাঁদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আরও সতর্ক হতে হবে যেন পুলিশ সদস্যরা কোনো অপরাধে জড়িয়ে না পড়েন।

Share