দক্ষিণ এশিয়ায় একক মুদ্রা চালুর সম্ভাবনা নিয়ে ঢাকায় আলোচনা

বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করে এই সময় এখনও আসেনি

নয়াবার্ত‍া প্রতিবেদক : ইউক্রেইন-রাশিয়া ‍যুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পাদনে কিছু দেশের ডলারের বিকল্প খোঁজার চেষ্টার মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য একক মুদ্রা চালু করা সম্ভব কি না, সে প্রশ্নে আলোচনা হল ঢাকায় এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে।

শনিবার ঢাকার একটি হোটেলে ‘রিফ্রামিং সাউথ এশিয়ান রিজিওনাল কো-অপারেশন ইন দ্যা নিউ কনটেস্কট’ শীর্ষক দুই দিনের এ সম্মেলনে আফগানিস্তান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার সবগুলো দেশের প্রতিনিধি অংশ নেন।

বাংলাদেশের বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সঙ্গে যৌথভাবে এ সম্মেলনের আয়োজন করে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের একটি করে প্রতিষ্ঠান। এতে অংশ নেন বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধিরাও।

ভারতের রিসার্চ অ্যন্ড ইনফরমেশন সিস্টেম ফর ডেভেলপিং কান্ট্রিজ (আরআইএস), নেপালের সাউথ এশিয়া ওয়াচ অন ট্রেড ইকোনমিকস অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট (এসএডব্লিউটিইই), পাকিস্তানের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট পলিসি ইনস্টিটিউট (এসডিপিআই) ও শ্রীলঙ্কার ইনস্টিটিউট অব পলিসি স্টাডিস (আইপিএস) এ সেমিনারের যৌথ আয়োজক।

এতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মুদ্রা ‘ইউরো’র মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো নিজেদের জন্য স্বতন্ত্র একক কোনো মুদ্রা ব্যবহার করতে পারে কি না- তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা একটি প্লেনারি সেশনে আলোচনা করেন।

সেখানে দুই পক্ষেই নানা যুক্তি উঠে আসে। কেউ বলেন, একক মুদ্রা বৈদেশিক বাণিজ্যে দেশগুলোর খরচ ও সময় কমিয়ে দেবে। কেউ বলেন, ইউরোপের আদলে একক মুদ্রা চালুর বাস্তবতা এখনও এখানে হয়নি।

বাংলাদেশি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআরআই) এর নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর একক মুদ্রা চালুর পক্ষে।তিনি বলেন, “শুধু বাণিজ্যকে সামনে রেখে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য স্বল্প পরিসরে হলেও একক মুদ্রার প্রচলন হতে পারে।”

দেশগুলোর আমদানি-রপ্তানি ও শুল্কায়ন প্রক্রিয়া একই ধরনের হওয়া উচিত বলেও মনে করেন তিনি। তার মতে এ উদ্যোগে দেশগুলো লাভবান হবে।

তিনি বলেন, “একেকটি দেশের পণ্য শুল্কায়ন প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত ডকুমেন্ট বা কাগুজে প্রমাণাদির সংখ্যা ভিন্ন। এতে সময় ও অর্থের খরচ বেশি হয়। একটি নির্দিষ্ট ছকে সবাই শুল্কায়ন করলে তা সময় ও অর্থ খরচ বাঁচিয়ে দেবে।”

ভারতের রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম ফর ডেভেলপিং কান্ট্রিজ (আরআইএস) এর মহাপরিচালক শচীন চর্তুবেদি বলেন, “বিশ্বব্যবস্থায় ডলার এখন মূল্যস্ফীতির জন্য দায়ী হয়ে পড়ছে। পুরো বিশ্বের অর্থনীতিকে ডলারের মতো একটি মাত্র মুদ্রার পক্ষে লেনদেনের মাধ্যম হওয়া কঠিনতর।

“আন্তর্জাতিক লেনদেনে ডলারের একক প্রভাবের কারণে এর ব্যবস্থাপনা খরচও বেশি। এজন্য ডলারের বিকল্প মুদ্রা ব্যবহারের সুযোগগুলো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো দেখতে পারে।”

পাকিস্তানের গবেষণা সংস্থা সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট পলিসি ইনস্টিটিউট (এসডিপিআই) এর নির্বাহী পরিচালক আবিদ কাউয়ুম সুলেরি বলেন, “অর্থনৈতিক, সামরিক শক্তিতে ভারসাম্য থাকলে একক মুদ্রা ব্যবহার সম্ভব। নতুন মুদ্রা আইএমএফ এর এসডিআর এর মতো বিনিময় হারকে ধরেও হতে পারে।”

তবে বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনোমিস্ট জাহিদ হোসেনের মত, “সার্বভৌমত্বের বিবেচনায় একক মুদ্রা বা সিঙ্গেল কারেন্সি চলার মতো প্রেক্ষাপট এখনও তৈরি হয়নি।”

তিনি বলেন, ‘‘একটি অঞ্চলের জন্য একক মুদ্রা প্রচলন করতে বেশ কিছু বিষয় বিবেচনা নিতে হয়। তার মধ্যে অর্থের অবাধ চলাচল, সীমান্ত অতিক্রম করার স্বাধীনতা, ঝুঁকি সহনশীলতা, পারস্পরিক আস্থা, একটি বিশেষায়িত নিয়ন্ত্রক সংস্থ ইত্যাদি।

“একই ভৌগোলিক সীমায় অবস্থানের পরও দক্ষিণ এশিয়ার অবস্থিত প্রতিটি দেশের অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবেলার সক্ষমতা ভিন্ন ভিন্ন। ডলারের বিপরীতে ভারতের রুপি বেশ অস্থিতিশীল হিসেবে আচরণ করে আসছে গত কয়েক দশক ধরে “

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান বলেন, ‘‘সীমান্ত খুলে দেওয়া, বাধাহীন সীমান্ত অতিক্রম, শ্রমজীবী মানুষের অবাধ চলাচল ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, প্রচলিত মুদ্রার দায়, অন্য দেশের প্রতি কর্তৃত্বপরায়ণতা থাকার মতো বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়ার প্রয়োজন হয় একক মুদ্রা পরিচালনা করতে। এসব পরিবেশ এখনও না হওয়ায় দক্ষিণ এশিয়ায় একক মুদ্রা ব্যবহারের সময় হয়নি।”

এর আগে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ কয়েকটি দেশ মিলে ‘রুপা’ নামের একক মুদ্রার প্রচলন করেছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “সেই উদ্যোগও ফলপ্রসু হয়নি।”

Share