দুই দেশের জঙ্গিদের সমন্বয়ক ছিলেন আবু তালহা

নয়াবার্তা প্রতিবেদক : ভারতে মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গি ময়মনসিংহের ইকরামুল হক ওরফে আবু তালহা (২৮)। দেশটিতে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আলকায়দা ইন ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্টের (একিউআইএস) উপপ্রধানের দায়িত্বে ছিলেন। সংগঠনটির দাওয়াহ শাখারও শীর্ষ নেতা তিনি। দুর্ধর্ষ এ জঙ্গি প্রতিবেশী দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধাওয়ার মুখে দেশে ফিরে ময়মনসিংহে নিজ গ্রামে মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছিলেন। আড়ালে দুই দেশের জঙ্গিদের সমন্বয়কের ভূমিকা পালনের পাশাপাশি অনলাইনে মডিউল তৈরিতে দিচ্ছিলেন জঙ্গি প্রশিক্ষণ। ঢাকার কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সদস্যরা তাকে গ্রেপ্তার করলে তার পরিচয় বেরিয়ে আসে।

সিটিটিসি কর্মকর্তারা বলছেন, গত ৩০ এপ্রিল ঢাকার মাদারটেক এলাকা থেকে দুর্ধর্ষ ওই জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই সময়ে গ্রেপ্তার হন তার স্ত্রী ও সংগঠনটির নারী শাখার সদস্য ফারিয়া আফরিন অনিকা (২০)।

কাউন্টার টেররিজম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের ডিসি এসএম নাজমুল হক বলেন, ভারতে কয়েক জঙ্গি ধরা পড়ার পর সংগঠনের নির্দেশে আবু তালহা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিলেন। এরপর দেশে বসে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের হয়ে কাজ করছিলেন। পাশাপাশি এনক্রিপ্টেড অ্যাপসের মাধ্যমে ভারতেও সংগঠনের সদস্যদের নানা নির্দেশনা দিয়ে আসছিলেন।

তিনি বলেন, ওই জঙ্গিকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে দেশে জঙ্গি কার্যক্রমের গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্য মিলেছে। পাশাপাশি তিনি আদালতেও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

জঙ্গি কার্যক্রম মনিটরিংয়ে যুক্ত পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, ভারতে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আলকায়দার আদর্শে উজ্জীবিত উগ্রবাদীরা ‘একিউআইএস’ নাম নিয়ে তাদের কার্যক্রম চালান। বাংলাদেশে ওই সংগঠনটি আনসার আল ইসলাম নামে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।

সিটিটিসি সূত্র জানায়, আবু তালহা জালিয়াতি করে তার নিজের ও স্ত্রী ফারিয়া আফরিন অনিকার নামে ভারতীয় নাগরিকত্বও নিয়েছিলেন। নিজে ভারতের পাসপোর্টও নিয়েছেন পরিচয় গোপন করে। ভারতীয় পাসপোর্টে তার নাম নূর হোসেন। সেখানে বাবার নাম সাবু মিয়া ও মা নাবিয়া বিবি। ভারতীয় পাসপোর্টে তার ঠিকানা কোচবিহারের সিংহীমারির মদনকুরা গ্রাম। এ ছাড়া তালহা তার বাংলাদেশি স্ত্রী ফারিয়া আফরিন অনিকার মরিয়ম খাতুন দিয়ে ভারতীয় আধার কার্ড তৈরি করেন। সেখানে অনিকার বাবার নাম দেওয়া হয়েছে নান্নু মিয়া। ভারতে তালহার বিরুদ্ধে অন্তত ১০টি মামলা রয়েছে।

সিটিটিসির দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, আবু তালহা যে এনক্রিপ্টেড অ্যাপসের মাধ্যমে যোগাযোগ করতেন, তার সবকিছু ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে উদ্ঘাটন করা হয়েছে। একিউআইএসের সদ্য সাবেক প্রধান ওয়াসিম ওমরসহ দেশি-বিদেশি অনেক শীর্ষ নেতার সঙ্গে তার যোগাযোগের তথ্য মিলেছে তাতে। বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও আধ্যাত্মিক নেতা মাওলানা ওসমান গনি ও শাইখ তামিম আল আদনানীর সঙ্গেও তার যোগাযোগের তথ্য পাওয়া গেছে।

ওই কর্মকর্তা বলেন, ২০২২ সালের অক্টোবরে ভারতের মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের ভোপাল থেকে আট একিউআইএস সদস্যকে গ্রেপ্তার করে দেশটির এন্টি টেররিজম স্কোয়াড (এটিএস)। ওই সময় গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন বাংলাদেশি নাগরিক। জিজ্ঞাসাবাদে তারা ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাদের শীর্ষ নেতা হিসেবে ইনামুল হক ওরফে আবু তালহার কথা জানান। চলতি বছরের ২৪ মে ভারতের গুজরাট থেকে আরও চার একিইউআইএস সদস্য গ্রেপ্তার হন এটিএসের হাতে। তারাও ছিলেন বাংলাদেশি নাগরিক। জিজ্ঞাসাবাদে তারা ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তাদের নিয়োগকারী হিসেবে আবু তালহার বিষয়ে তথ্য দেন। এর পরই মূলত তালহা নিরাপত্তাজনিত কারণে দেশে ফিরে আসেন।

সিটিটিসির কাউন্টার টেররিজম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, ২০২১ সালে নারায়ণগঞ্জ থেকে খালেদ সাইফুল্লাহ নামে এক জঙ্গিকে গ্রেপ্তারের পর এ আবু তালহার বিষয়ে তারা প্রথম তথ্য পেয়েছিলেন। তালহা তখন মাওলানা সাবেত নামে জঙ্গি গ্রুপে পরিচিত ছিল। খালেদ সাইফুল্লাহ জিজ্ঞাসাবাদে তখন জানিয়েছিলেন, ভারতে অবস্থান করা ‘মাওলানা সাবেত’ একিউএসের শীর্ষ নেতা। তিনি ভারতে বসে ভারত ও বাংলাদেশের একিইউআইএসের সদস্যদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিতেন ও সদস্য সংগ্রহ করতেন।

ওই কর্মকর্তা বলেন, আবু তালহাকে গ্রেপ্তারের পরও জামিনে থাকা খালেদ সাইফুল্লাহকে তার ছবি দেখিয়েছি। খালেদ সাইফুল্লাহ তাকে মাওলানা সাবেত নামে শনাক্ত করেছেন। জামিনে কারামুক্তি পেলেও খালেদ সাইফুল্লাহ সিটিটিসির নিয়মিত নজরদারির মধ্যে রয়েছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।

সিটিটিসি জানায়, ময়মনসিংহে জন্ম নেওয়া আবু তালহা রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকার একটি মাদ্রাসা ও ফরিদাবাদ মাদ্রাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস বিষয়ে পড়াশোনা করেন। ২০১৮ সালে তিনি ভারতের দেওবন্দে উচ্চতর পড়াশোনা করতে যান। প্রথমে ট্যুরিস্ট ভিসায় গিয়ে দেওবন্দে ভর্তি হলেও পরে নুর হোসেন নামে ভারতীয় আধার কার্ড সংগ্রহ করেন এবং ভারতীয় পাসপোর্টও বাগিয়ে নেন। দেওবন্দে পড়তে গিয়েই তিনি একিউআইএসের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন।

গ্রেপ্তারের পর সিটিটিসির জিজ্ঞাসাবাদে আবু তালহা জানিয়েছেন, তিনি দেওবন্দের মাদ্রাসায় পড়তে গিয়ে আমান নামে একজনের মাধ্যমে একিউআইএসের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। একিউআইএসের সাংগঠনিক কাজে তিনি কুচবিহার, ভোপাল, আসাম, দিল্লিসহ বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে থেকেছেন। অনলাইন ও অফলাইনে সংগঠনে নতুন যোগ দেওয়া সদস্যদের ক্লাস নিতেন তিনি।

সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা বলেন, আবু তালহা ছাত্রজীবন থেকেই মেধাবী। তিনি ২০০৭ সালে বেফাকের অধীনে হিফজ পরীক্ষায় সারা দেশে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। বাংলার পাশাপাশি উর্দু, আরবি ও ইংরেজি ভাষায় তার দক্ষতা রয়েছে। প্রযুক্তি জ্ঞানেও তার দখল রয়েছে।

Share