ধর্ষকের সঙ্গে কিশোরীর বিয়ে, ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে বললেন বিচারক

নয়াবার্ত‍া ডেস্ক : মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষণের শিকার কত মেয়ের সন্তান জন্ম নিয়েছে। ওই মেয়েরা কি পাকিস্তানি ধর্ষককে বিয়ে করেছেন?’ ‘বোনের দিকে তাকিও না। তুমি নিজে বলো। বাসায় গিয়ে ঠান্ডা মাথায় নিজে সিদ্ধান্ত নাও। তুমি কি চাও একটা আসামিকে বিয়ে করতে? তোমার সামনে ভবিষ্যৎ পড়ে আছে। তুমি ছোট একটা মানুষ। তোমার সন্তান আছে। সে বড় হয়ে কী বলবে? এমন একটি লোককে বিয়ে করলে?

ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক সাবেরা সুলতানা খানম আজ মঙ্গলবার সকাল ১১টায় এজলাসে বিচারকার্য পরিচালনার সময় বিচার প্রার্থী এক ধর্ষিতা কিশোরীর উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলেন।

আদালতের সামনের বারান্দায় দেখা যায় লোকজনের ভিড়। ৩০ মিনিটের মধ্যে আদালতের ভেতরের সব বেঞ্চ আইনজীবী, বাদী আর স্বজনদের দখলে চলে যায়। কারাগারে থাকা আসামিদের আনা শুরু হতে থাকে। এক পাশে লোহার খাঁচার ঘরে আসামিদের একে একে প্রবেশ করানো হচ্ছিল। বেলা পৌনে ১১টায় বিচারক আসন নেওয়ার পর বিচারকাজ শুরু হয়।

সকালে আদালত কক্ষে প্রবেশের সময় সামনের বারান্দায় বেঞ্চে এক কিশোরীকে এক নারীর সঙ্গে বসে থাকতে দেখা যায়। বেলা সোয়া ১১টার দিকে মামলার ক্রম অনুসারে ডাক আসার পর দেখা যায়, ওই কিশোরী দ্বিধাগ্রস্ত পায়ে বিচারক সাবেরা সুলতানা খানমের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সঙ্গে ওই নারী (বড় বোন)। পরে মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, ওই কিশোরী দুই বছর আগে ১২ বছর বয়সে ধর্ষণের শিকার হয়। তাকে ধর্ষণ করেছিলেন পাড়ার বয়স্ক এক দোকানদার। গত বছর একটি মেয়েসন্তান প্রসব করেছে ওই কিশোরী। দুই বছর ধরে আসামি কারাগারে। এ অবস্থায় দুই পক্ষই একটি আপসরফায় আসতে চাইছে।

শুনানিতে আসামিপক্ষের আইনজীবী শিশুসন্তান ও সামাজিক স্বীকৃতির প্রসঙ্গ তোলেন। দুই পক্ষই বিয়ের বিষয়ে সম্মত বলে জানায়।

এ সময় বিচারক কিশোরীকে বলেন, ‘ওই বয়স্ক লোকটাকে কি তুমি বিয়ে করবে?’ উত্তরে কোনো জবাব না দিয়ে তাকিয়ে থাকে কিশোরী। বিচারক খাঁচার ঘরে দাঁড়িয়ে থাকা চুল–দাড়ি পাকা এক ব্যক্তির দিকে নির্দেশ করে কিশোরীকে আবার বললেন, ‘পেছনে তাকিয়ে দেখো, ওই চুল–দাড়ি পাকা বয়স্ক লোকটাকে তুমি বিয়ে করতে চাও?’ মেয়েটি পেছনে ঘাড় অল্প ঘোরালেও খাঁচার দিকে তাকায় না, পাশে থাকা বোনের দিকে তাকায়। এ সময় আদালতে উপস্থিত দু–তিনজন নারী নিচু স্বরে বলে ওঠেন, ‘এ রকম একটি লোকের সঙ্গে বিয়ে কী করে সম্ভব!’

কিশোরীকে বিচারক বলেন, ‘বোনের দিকে তাকিও না। তুমি নিজে বলো। বাসায় গিয়ে ঠান্ডা মাথায় নিজে সিদ্ধান্ত নাও। তুমি কি চাও একটা আসামিকে বিয়ে করতে? তোমার সামনে ভবিষ্যৎ পড়ে আছে। তুমি ছোট একটা মানুষ। তোমার সন্তান আছে। সে বড় হয়ে কী বলবে এমন একটি লোককে বিয়ে করলে? মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষণের শিকার কত মেয়ের সন্তান জন্ম নিয়েছে। ওই মেয়েরা কি পাকিস্তানি ধর্ষককে বিয়ে করেছেন?’

কিশোরী নিশ্চুপই ছিল। একপর্যায়ে মেয়েটির বোন, আসামিপক্ষের আইনজীবী ও রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদের উদ্দেশে বিচারক বলেন, ‘মেয়েটার পুরো ভবিষ্যৎ সামনে পড়ে আছে। সবাই মিলে কীভাবে মেয়েটিকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়, সেই চেষ্টা করুন। ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দিয়েন না। এই মেয়েটি প্রতিষ্ঠিত হলে অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়াবে।’

শুনানি শেষে বেলা একটায় আদালতের বিচারকাজ শেষ হলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল–৭–এর বিশেষ সরকারি কৌঁসুলি আফরোজা ফারহানা আহমেদ বলেন, এটা খুব সংবেদনশীল একটা মামলা। ঘটনার সময় মেয়েটির বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর। বাদী যদি আপস করে, তাহলে রাষ্ট্রের ভূমিকা এখানে কী হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটা শিশুর এ রকম নির্যাতনের ঘটনায় রাষ্ট্র আপস করতে চায় না। সরকারি কৌঁসুলিরা আপসের বিষয়ে বাধা দেবে।

ওই ট্রাইব্যুনালের সহকারী সরকারি কৌঁসুলি মোহাম্মদ লিয়াকত আলী বলেন, ‘আজ শুনানির সময়ও বলেছি, এ মামলায় আসামি ১৬৪ ধারায় একাধিকবার ধর্ষণের কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। এটায় আপস হবে না।’

ওই কিশোরীর শিশুসন্তানকে একজন পুলিশ কর্মকর্তা দত্তক নিয়েছেন বলে বিশেষ সরকারি কৌঁসুলি আফরোজা ফারহানা আহমেদ জানিয়েছেন।

মামলার এজাহার থেকে জানা গেছে, ভুক্তভোগী কিশোরী রাজধানীর মাটিকাটা এলাকায় পরিবারের সঙ্গে থাকত। একটি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত। বাসার কাছে আসামি মো. আনোয়ারুল হকের (৫৫) মুদিদোকান ছিল। ওই দোকান থেকে নিয়মিত কেনাকাটা করার কারণে কিশোরীর পরিবারের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। কিশোরী দোকানের সামনে দিয়ে মাটিকাটা এলাকার একটি কোচিং সেন্টারে আসা–যাওয়া করত। ঘটনার দিন ২০২২ সালের ১ এপ্রিল এটা–সেটা কিনে দিয়ে কিশোরীকে কাছে ডেকে নেন আনোয়ারুল হক এবং দোকানের ভেতরে নিয়ে ধর্ষণ করেন। এরপর আরও কয়েকবার ভয় দেখিয়ে কিশোরীকে ধর্ষণ করেন তিনি। ভয়ে ওই কিশোরী বোনকেও কিছু বলেনি। একপর্যায়ে মেয়েটির শরীরে নানা রকম সমস্যা দেখা দিলে ওই বছরের নভেম্বর মাসে বড় বোন তাকে একটি হেলথ কেয়ার সেন্টারে নিয়ে যান। বিভিন্ন পরীক্ষা–নিরীক্ষার পর চিকিৎসক জানান, কিশোরী অন্তঃসত্ত্বা। পরে জিজ্ঞাসা করলে কিশোরী সব ঘটনা জানায়। ঘটনার সাত মাস পর বড় বোন বাদী হয়ে আনোয়ারুল হককে আসামি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ (১) (ধর্ষণের ধারা) ধারায় মামলা করেন।

মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে আসামিপক্ষের আইনজীবী মো. ইসমাঈল ভূঞা বলেন, আনোয়ারুল হকের স্ত্রী ও বড় বড় ছেলেমেয়ে আছে। তাঁরাই আসামির পক্ষে মামলা দেখছেন। দুই বছর ধরে আসামি কারাগারে। দুই পরিবারই বিয়ের মাধ্যমে আপস চাইছে। সেসব চিন্তা করে আপসের কথা বলা হয়েছে আদালতে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আদালতের নির্দেশে ধর্ষকের সঙ্গে ভুক্তভোগীর বিয়ের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। ২০২১ সালে ১১ ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ধর্ষকের সঙ্গে ভুক্তভোগীর বিয়ের ঘটনা ঘটে। ভুক্তভোগীর সঙ্গে বিয়ের শর্তে এক বছর কারা ভোগের পর জামিন পান নাজমুল হোসেন নামের এক ব্যক্তি। জামিনের পর কাজির মাধ্যমে আদালতে বিয়ে হয়। ২০২২ সালের মার্চ মাসে পঞ্চগড়ে বিধবা এক নারীকে (৩৭) ধর্ষণের দায়ে কারাগারে যেতে হয়েছিল পুলিশের এক উপপরিদর্শককে (এসআই)। পঞ্চগড় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতের বিচারক ওই নারীকে বিয়ের শর্তে জামিন দেন এসআই আবদুল জলিলকে। আসামির প্রথম স্ত্রীও বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন।

দুই পক্ষের আপসের মাধ্যমে আসামির জামিন করানোর জন্য এমন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মানবাধিকারকর্মীরা বরাবর অবস্থান নিয়ে আসছেন। তাঁদের মতে, ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে নারীর জন্য অমর্যাদাকর। আর জামিন নেওয়ার জন্য বিয়েটা হয় বলে ওই বিয়ে টেকে না। ওই নারীর জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, পুরুষশাসিত সমাজে নারীকে সমান চোখে দেখা হয় না বলেই এ ধরনের একটি অসম্মানজনক ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হয়। নারী ও মেয়েশিশুর সম্মান বাঁচানোর নামে অন্যায় ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিয়ে দেওয়া হয়। আসামি ও ভুক্তভোগী কেউই এ বিয়েতে খুশি থাকে না। বিয়েটাও টেকে না। তিনি বলেন, ধর্ষকের শাস্তি নিশ্চিত করা আদালতের কাজ। আদালত বলে দিতে পারেন না ভুক্তভোগীর কার সঙ্গে বিয়ে হবে।

Share