নতুন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত নিয়াজ গার্মেন্টস, এনসিসি ব্যাংকের দায় এড়াতে সম্পত্তি হস্তান্তর করছে চেয়ারম্যান

নয়াবার্তা প্রতিবেদক : বেসরকারি ন্যাশনাল ক্রেডিট এন্ড কমার্স ব্যাংক লিমিটেড (এনসিসিবিএল) এর বর্তমানে সুদাসলে পাওনা ৪ কোটিরও অধিক টাকার দায় হতে বাাঁচার জন্য নিয়াজ গার্মেন্টস ইন্ড্রাষ্ট্রিজ প্রাইভেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান নিজ নামের সম্পত্তি হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ঢাকার তৃতীয় অর্থ ঋণ আদালতের অর্থ জারি ৮৪/২০০৩ নং মোকাদ্দমায় কোম্পানির চেয়ারম্যান বিগত ১৪ বছর যাবৎ পলাতক থাকায় দীর্ঘ ২৫ বছরেও এনসিসি ব্যাংক তাদের অবলোপনকৃত এই অনাদায়ী টাকা আদায় করতে পারেনি। তথানুসন্ধানে জানা গেছে, নিয়াজ গার্মেন্টসের চেয়ারম্যান রোকসানা পারভীন ঢাকার অতিরিক্ত জেলা জজ ও দেউলিয়া বিষয়ক আদালতের দেউলিয়া বিষয়ক ৪/১৯৯৯ নং মামলায় ২০১০ সালের ৮ নভেম্বর প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেটের গেজেটভূক্ত দেউলিয়া। এ মোকাদ্দমায় আদালত ০১/০৩/২০২২ ইং তারিখে ২৩৭ নং আদেশে বিবাদী পক্ষকে দেউলিয়া ঘোষণাদেশ হতে অব্যাহতি দিয়ে দায় হতে অবমুক্ত ঘোষণা করলেও সেটি বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশ করেনি।

বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক সূত্র জানায়, নিয়াজ গার্মেন্টস ইন্ড্রাষ্ট্রিজ প্রাইভেট লিমিটেড নামক প্রকল্পের চেয়ারম্যান রোকসানা পারভীন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেজর (অবঃ) কাজী মাজেদুর রহমান, পরিচালক নাজনীন হক ও মেজর (অবঃ) মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক কর্তৃক বিগত ১১/০৮/৯৩ ইং তারিখে মঞ্জুরীকৃত ৪০ লাখ ৪৩ হাজার টাকার বৈদেশিক মুদ্রার ঋণের বিপরীতে বিগত ০৪/০১/৯৫ ইং তারিখে দেশীয় মুদ্রার ৩৯ লাখ ৭৫ পঁচাত্তর হাজার টাকার দীর্ঘ মেয়াদী ঋণ ব্যয়ন গ্রহন করেন। অতঃপর শিল্প ব্যাংকের বরাবরে কোম্পানী যাবতীয় চার্জ ডকুমেন্টস সম্পাদন করেন। প্রকল্পটি বিগত ০১/০১/৯৫ ইং তারিখে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চালু হয়। মঞ্জুরীর শর্ত মোতাবেক বিদেশ হতে প্রকল্পের জন্য আমদানীকৃত সমুদয় মেশিনপত্র প্রকল্প স্থানে স্থাপন করেন। ২৩/০৩/৯৮ ইং তারিখে শিল্প ব্যাংক কর্তৃক গঠিত পরিদর্শনকারী টীম পরিদর্শনকালে দেখতে পায় যে, প্রকল্প হতে ব্যাংকের বিনা অনুমতিতে ২০ টি মেশিন সরিয়ে নেয়া হয়েছে। সূত্র জানায়, নিয়াজ গার্মেন্টস ইন্ড্রাষ্ট্রিজ প্রাইভেট লিমিটেড নামক প্রকল্পটি ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট থানার ২৩৪/১, কচুক্ষেত, (ইব্রাহীমপুর) নামক স্থানে ভাড়া বাড়ীতে অবস্থিত হওয়ায় কোম্পানী দীর্ঘমেয়াদী ঋণের বিপরীতে তৃতীয় পক্ষের ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ জমি ব্যাংকে সহজামানত প্রদান করেন। যার তপসিল, জিলা ঢাকা, থানা ও সাব রেজিস্ট্রী অফিস সাবেক তেজগাঁও, হালে ক্যান্টনমেন্ট। মৌজা কাফরুল, খতিয়ান নং ১১৩, দাগ নং ৮১, জমির পরিমান ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ। বিগত ১০/১১/৯৩ ইং তারিখে ব্যাংক কর্তৃক উক্ত জমির মুল্য ২১ লাখ ২৩ হাজার টাকা নির্ধারন করা হয়েছিল। নিয়াজ গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষ প্রকল্প হতে বিনা অনুমতিতে গোপনে ২০ টি মেশিন সরিয়ে নেয়ার ঘটনা জানার পর শিল্প ব্যাংক তদন্তে দেখতে পায় যে, অন্যান্য জমির সাথে আলোচিত সহ-জামানতকৃত ৮১ নং দাগের পুরো জমি ১৯৬১ সালে তৎকালীন বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা অধিগ্রহন করে। পরবর্তীতে ১৯/০২/৮৯ ইং তারিখে তা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যাস্ত করা হয়। এরপর ২২/০৩/৯৮ ইং তারিখে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পত্রের মাধ্যমে তেজগাঁও পুরাতন বিমান বন্দর এলাকার হুকুম দখলকৃত জমি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অনুকুলে বরাদ্দ করা হয়। এই ঘটনা জানার পর শিল্প ব্যাংক নিয়াজ গার্মেন্টসের বিরুদ্ধে ঢাকার মূখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে বাংলাদেশ দন্ডবিধি আইনের ৪০৬, ৪২০ ও ৪২২ ধারায় ৩০৮৯/৯৮ নং পিটিশন মামলা দায়ের করে। সূত্র জানায়, এই মামলার প্রেক্ষাপটে নিয়াজ গার্মেন্টসের চেয়ারম্যান রোকসানা পারভীন রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত তাঁর বসত বাড়ী শিল্প ব্যাংকের ঋণের বিপরীতে বন্ধক দিতে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক, ঢাকার অতিরিক্ত জেলা জজ ও দেউলিয়া বিষয়ক আদালতে দেউলিয়া বিষয়ক ৪/১৯৯৯ নং মামলা দায়ের করে। এই মোকাদ্দমায় ২৬/০৬/২০০০ ইং তারিখে বেসরকারি ন্যাশনাল ক্রেডিট এন্ড কমার্স ব্যাংক লিমিটেড (এনসিসিবিএল) তৃতীয়পক্ষ ভূক্তির আবেদন করে। দেউলিয়া বিষয়ক আদালতের ২৯/০৬/২০০০ ইং তারিখের আদেশে বলা হয়, “মামলাটি বর্তমান পর্যায়ে সহ-পাওনাদার হিসেবে এনসিসি ব্যাংকের পক্ষভূক্তির আবেনটি আইনানুযায়ী গ্রহণযোগ্য নয় বিধায় দাখিলকৃত আইনজীবী বরাবর ফেরৎ প্রদানের নির্দেশ দেয়া হলো।” দেউলিয়া বিষয়ক ৪/১৯৯৯ নং মামলায় শিল্প ব্যাংক দীর্ঘ ২৭ বছর আইনী প্রচেষ্টা চালিয়ে বন্ধকী সম্পত্তি নিলাম করিয়েও টাকা উদ্ধারে ব্যর্থ হয়। অবশেষে এক সাংবাদিকের নেপথ্য সহযোগিতায় ব্যাংক ২০২২ ইং সালে এই টাকা ফিরে পায়।

অন্যদিকে, নিয়াজ গার্মেন্টস, ৩৫/২, কাকরাইল, থানা:- মতিঝিল, জেলা ঢাকার ঠিকানা ব্যবহার করে তাদের ২৩৪/১ কঁচুক্ষেত, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট ঠিকানার কারখানাটি এনসিসি ব্যাংকের মগবাজার শাখায় মর্টগেজ রেখে ১৯৯৮ সালে ২২ লাখ ৯ হাজার ১৪১ ডলার অর্থাৎ তৎকালীন বাংলাদেশী মূদ্রায় ৬৭ লাখ ৭৯ হাজার ৭৭৪ টাকা মূল্যের পৃথক ৫টি এলসি খোলে। এসব এলসির বিপরীতে শিপিং ডকুমেন্ট আসলে নিয়াজ গার্মেন্টস চট্রগ্রাম বন্দর থেকে মালামাল ছাড়িয়ে নেয়। অতঃপর হঠাৎ নিয়াজ গার্মেন্টস তাদের কঁচুক্ষেত ঠিকানার কারখানা রাতের অন্ধকারে গুটিয়ে ফেলে। পরবর্তী ৪ বছরে এনসিসি ব্যাংক ঋণের টাকা ফেরৎ না পেয়ে ২০০২ সালে নিয়াজ গার্মেন্টসের নিকট সুদাসলে পাওনা ৮৪ লাক্ষ ১০ হাজার ৫৭৪ টাকার ঋণ আদায়ে ঢাকার বিজ্ঞ যুগ্ন জেলা জজ, তৃতীয় অর্থ ঋণ আদালতে ৯/২০০২ নং মানি মোকাদ্দমা দায়ের করে। এই মোকাদ্দমায় ডিগ্রী পাবার পর এনসিসি ব্যাংক একই আদালতে ৮৪/০৩ নং অর্থ জারী মোকাদ্দমা দায়ের করে। অর্থ জারি মোকাদ্দমায় ২০/০৩/২০০৪ ইং তারিখ পর্যন্ত নিয়াজ গার্মেন্টসের নিকট সুদাসলে পাওনা দাড়ায় ১ কোটি ১৮ লাখ ৬১ হাজার ১৩৬ টাকা।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ৮৪/২০০৩ নং অর্থ জারি মোকাদ্দমায় তপসিলের বন্ধকী কারখানা নিয়াজ গার্মেন্টস রাতের আধাঁরে গুটিয়ে ফেলে। এনসিসি ব্যাংকের উক্ত শাখায় বিবাদীদের অন্য কোন জমি বা সম্পত্তি মর্টগেজ নেই। উপরন্ত ঐসময় বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকের অনাদায়ী ঋণের টাকা আদায়ে নিয়াজ গার্মেন্টসের চেয়ারম্যানের দৃশ্যমান সম্পত্তি ঢাকার অতিরিক্ত জেলা জজ ও দেউলিয়া বিষয়ক আদালতের ৪/১৯৯৯ নং মোকদ্দমায় আদালতের নিয়ন্ত্রনাধীন ছিলো। ফলে এনসিসি ব্যাংকের অর্থ জারি ৮৪/২০০৩ নং মোকাদ্দমায় বিবাদীদের সম্পত্তি ক্রোক করে নিলাম বিক্রয় কার্যক্রম সম্ভবপর হয়নি। এ কারণে ঢাকার বিজ্ঞ যুগ্ন জেলা জজ তৃতীয় অর্থ ঋণ আদালত বিগত ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর ইং তারিখে ফৌজদারী কার্যবিধির ৭৫ ধারায় নিয়াজ গার্মেন্টসের চেয়ারম্যান রোকসানা পারভীনসহ অন্যান্য আসামীদের বিরুদ্ধে এনসিসি ব্যাংকের গ্রেফতারী পরোয়ানা জারির আবেদন মঞ্জুর করেন। কিন্তু অর্থ জারি মোকাদ্দমায় নিয়াজ গার্মেন্টসের ঠিকানা ৩৫/২ কাকরাইল, থানা;- মতিঝিল, উল্লেখ থাকায় গ্রেফতারী পরোয়ানা তামিল করতে এসে স্থানীয় পুলিশ দেখতে পায় যে, এই ঠিকানায় নিয়াজ গার্মেন্টস ইন্ড্রাষ্ট্রিজ (প্রাঃ) লিঃ কোম্পানীর কোন অস্তিত্ব নেই এবং পূর্বেও কখনো ছিলোনা। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা সিটি জরিপকালে ৩৫/২ কাকরাইল, থানা;- মতিঝিল, ঢাকা, হোল্ডিং ঠিকানাটি ৩৬/২ কাকরাইল, থানা:- পল্টন, ঢাকা-১০০০ হয়েছে। নিয়াজ গার্মেন্টসের চেয়ারম্যান রোকসানা পারভীন এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে হাত করে বর্তমান সময় পর্যন্ত গ্রেফতার এড়িয়ে ৩৬/২ কাকরাইল (দ্বিতীয় তলা), থানা:- পল্টন, ঢাকা-১০০০ ঠিকানায় বহাল তবিয়তে বসবাস করছেন। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, এনসিসি ব্যাংকের ৮৪/২০০৩ নং অর্থ জারি মোকাদ্দমায় ২০১৭ সালের ২০ নভেম্বর অবধি নিয়াজ গার্মেন্টসের চেয়ারম্যান রোকসানা পারভীনসহ অন্যান্য আসামীদের বিরুদ্ধে পুলিশ গ্রেফতারী পরোয়ানা কার্যকর করতে না পারায় অর্থ ঋণ আদালত ৭৫ নং আদেশে, গ্রেফতারী পরোয়ানা কার্যকর হওয়া সাপেক্ষে নথী উপস্থাপন করার নির্দেশ দিয়ে চলমান মোকাদ্দমাটি স্থগিত করে রেখেছেন। ফলে এনসিসি ব্যাংকের বর্তমান সময় অবদি সুদাসলে ৪ কোটিরও অধিক টাকা অনাদায়ী অবস্থায় পড়ে রয়েছে।

Share