নির্দেশনা দিয়েই দায়িত্ব সারছে স্বাস্থ্য বিভাগ

নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে দেশের সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে একসঙ্গে করোনা আর সাধারণ রোগীদের চিকিত্সা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দেশের হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলো কি একসঙ্গে চিকিত্সা সেবা দিতে প্রস্তুত? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা শুধু রাজধানী আর বিভাগীয় শহরের কয়েকটি হাসপাতালেই সম্ভব। অধিকাংশ হাসপাতালে এটা সম্ভব নয়।

সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে করোনা পরিস্থিতি শুরুর পর থেকেই নানা ধরনের নির্দেশনা আসছে। কিন্তু কেউ সেটা মানছে কি-না তা তদারকির কোন উদ্যোগ নেই। ফলে বেসরকারি অধিকাংশ হাসপাতাল বা ক্লিনিক হাত পা গুটিয়ে বসে আছে। চিকিত্সকরা হাসপাতালে আসছেন না। এর জন্য তাদের কোন জবাবদিহিতাও নেই। তবে ব্যতিক্রম কেবল একটি বেসরকারি হাসপাতাল। ধানমন্ডির আনোয়ার খান মর্ডান মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য ২০০ বেড নির্ধারিত রেখে সাধারণ রোগীদেরও চিকিত্সা দেওয়া হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, ‘ঈদের সময় গ্রামাঞ্চলে অনেক মানুষ গেছেন। তারা সেখানে আক্রান্ত হলে এত মানুষ ঢাকায় এনে চিকিত্সা দেওয়া সম্ভব নয়। ফলে যে যেখানে আছে তার সেখানে চিকিত্সার ব্যবস্থা করতে হবে।’ কাজগুলো হচ্ছে কি-না কারা দেখভাল করে? জবাবে তিনি বলেন, এর জন্য সমন্বয় কমিটি আছে। তারা দেখে।

এর আগেও স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে বেশ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু তার অধিকাংশই পালন করেনি বেসরকারি হাসপাতালগুলো। সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর থেকেই বেসরকারি হাসপাতালের চিকিত্সকরা বাসায় বসে আছেন। অথচ করোনা রোগীর বাইরেও বহু রোগী আছেন। যারা চরম দূর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। বেসরকারি হাসপাতালে গেলেই প্রথমে বলা হয়, করোনা পরীক্ষা করা আছে কিনা। না থাকলে ডাক্তার রোগীই দেখেন না। করোনা রোগীদের চিকিত্সা নিয়ে সরকারী হাসপাতালগুলোতেও একই অবস্থা। অথচ গাইনী, কিডনী, লিভার, দুর্ঘটনার রোগীসহ নানা ধরনের রোগী চিকিত্সা পাচ্ছে না। এসব দেখভালের জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরে ভিজিলেন্স টিম আছে। কিন্তু করোনা শুরু হওয়ার পর তারা আর ঘর থেকে বের হন না।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন বিএমএ মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক দুলাল বলেন, প্রথমত উপজেলা হাসপাতালগুলোতে এটা কোনভাবেই সম্ভব না। সেখানে ৫০/৬০টি বেড। মাত্র ১২/১৪ জন স্টাফ। আইসিইউ বেড নেই। কি করে তারা করোনা রোগী আর সাধারণ রোগীদের সামলাবেন। উপজেলার ক্লিনিকগুলোর অবকাঠামো নেই। ভাড়া বাসায় ক্লিনিক করে চালায়। একই লিফটে রোগী, সাধারণ মানুষ উঠানামা করে। এটা করলে তো আরো বেশি মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন। তবে জেলা পর্যায়ে কিছুটা সম্ভব। তাদের আইসিইউ বেড আছে সামান্য। আসলে হাসপাতালগুলো ওভাবে তৈরিও না।

তবে রাজধানীতে বড় বড় বা বিভাগীয় শহরে যাদের ২০০ বেড বা এর বেশি বেড আছে তাদের পক্ষে এটি সম্ভব বলে মত দেন তিনি। ডা. দুলাল বলেন, সরকারি বেসরকারি হাসপাতালে বিদেশে সব রোগীর চিকিত্সা চালু হয়েছে। সেখানে একদিকে আইসুলেশন ওয়ার্ড, অন্যদিকে সাধারণ রোগী। ইয়োলো আর রেড মার্কিং করে দেওয়া আছে। ফলে পজেটিভ রোগীরা একদিন দিয়ে যাচ্ছেন। আর সাধারণ রোগীরা অন্যদিক দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু আমাদের দেশে যে আদেশগুলো দেওয়া হচ্ছে তার অধিকাংশ বাস্তবায়ন হয়নি। বেসরকারি হাসপাতাল বন্ধ করে বাসায় বসে আছে। ডাক্তাররা হাত-পা গুটিয়ে বসে আছেন। এটাই দুঃখজনক।

ঢাকা মেডিকেল কলেজে করোনা চিকিত্সায় গঠিত কমিটির প্রধান মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. মুজিবুর রহমান ইত্তেফাককে বলেন, চিকিত্সকদের ঘরে বসে থাকাটা দুঃখজনক। বড় হাসপাতালগুলো পরিস্থিতি সামলাতে পারে। তবে হাসপাতালগুলোর ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ড বয়, কর্মচারীদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা করতে হবে। সুইপারকেও সব ধরনের প্রোটেকশন দিতে হবে। নিরাপত্তা না দিয়ে শুধু চিকিত্সা দেওয়ার কথা বললে তো হবে না। বিশ্বে এভাবেই হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিত্সক ও ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, সামনে তো আমাদের বিরাট ঝুঁকি আছে। ফলে এখনই সবাইকে প্রস্থতি নিতে হবে। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সামগ্রী দিয়ে তাদের প্রস্তুত করতে হবে। তা না হলে পরিস্থিতি সামলানো কঠিন হয়ে পড়বে।

তবে বেসরকারী হাসপাতালগুলোর মধ্যে ব্যতিক্রম আনোয়ার খান মর্ডান মেডিকেল কলেজ। সেখানে করোনা রোগীদের জন্য ২০০ বেড চালু করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ১৬৭ জন রোগী ভর্তি আছেন। অনেক শিল্পপতিও সেখানে ভর্তি আছেন। প্রতিটি বেডের সঙ্গে কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ডাক্তাররা সেখানে ২৪ ঘণ্টা ডিউটি করছে। ইত্তেফাকের ফটোসাংবাদিক আব্দুল গনি গতকাল বৃহস্পতিবার করোনা ওয়ার্ড ঘুরে এসে জানান, সেখানে করোনা রোগী ও সাধারণ রোগীদের পৃথকভাবে চিকিত্সা দেওয়া হচ্ছে। সার্বক্ষনিক সেখানে চিকিত্সক-নার্স থাকছেন। রোগীরা তাদের সেবায় সন্তুষ্ট। ডাক্তাররা রোগীদের কাছে গিয়ে তাদের ঈদের শুভেচ্ছাও জানিয়েছেন।

আনোয়ার খান মর্ডান মেডিকেল কলেজের এমডি ও চেয়ারম্যান ড. আনোয়ার খান এমপি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি সুন্দর চিকিত্সার ব্যবস্থা করার জন্য। ২৫ কোটি ব্যয় করে এই ব্যবস্থা করেছি। এখন আসলে ব্যবসা নয়, মানুষের সেবার জন্য এই সুচিকিত্সার ব্যবস্থা করেছি।

উল্লেখ্য, বিএমএ’র হিসেবে এ পর্যন্ত ৭২০ ডাক্তার করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন ১১ জন। এর মধ্যে ৭ জন করোনা আক্রান্ত হয়ে। আর ৪ জন উপসর্গ নিয়ে। এছাড়া ৫৬৬ জন নার্স আক্রান্ত হয়েছেন। একজন মারা গেছেন। অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে ৮৭৯ জন আক্রান্ত হয়েছেন। আর একজন মারা গেছেন।

Share