নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, ভূমি সালিশি বোর্ড বিপুল ক্ষমতা পাচ্ছে

নয়াবার্তা প্রতিবেদক : জমিসংক্রান্ত অপরাধ কমিয়ে আনতে জেলা প্রশাসন এবং ভূমি সালিশি বোর্ডকে বিপুল ক্ষমতা দিয়ে নতুন আইন করতে যাচ্ছে সরকার। জমিসংক্রান্ত ছোটখাটো অন্যায়-অনিয়ম প্রতিরোধে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা তাৎক্ষণিকভাবে কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারবেন। অন্যদিকে জমিসংক্রান্ত পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি ও দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাতে ভূমি সালিশি বোর্ড গঠন করা হবে। একই সঙ্গে জমিসংক্রান্ত প্রতারণা বা জালিয়াতির মতো ঘটনার বিচার বিষয়ে উপযুক্ত দেওয়ানি আদালতের প্রাধান্য বজায় থাকবে।

এসব বিধান রেখে ‘ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন-২০২৩’ শীর্ষক খসড়া আইন প্রস্তুত করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়। আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের প্রস্তুতি চলছে। আইনটি কার্যকর হলে কাগজ যার জমি তার নীতি প্রতিষ্ঠিত হবে বলে মনে করছে ভূমি মন্ত্রণালয়। বর্তমানে দেশের বেশিরভাগ মামলা ভূমিসংক্রান্ত বিরোধের কারণে হয়ে থাকে। আলোচ্য আইন কার্যকর হলে এ সংক্রান্ত মামলা কমে যাওয়ার আশা করছে সরকার।

অন্যের জমিতে নিজের মালিকানা, তথ্য গোপন করে জমি বিক্রি, প্রাপ্যতার চেয়ে বেশি জমি বিক্রি, জমির বিষয়ে মিথ্যা তথ্য দেওয়া, মিথ্যা দলিল প্রস্তুত, সিল-স্বাক্ষর জালিয়াতি, দলিলের কোনো অংশ প্রতারণার মাধ্যমে পরিবর্তনের মতো জালিয়াতির জন্য সর্বোচ্চ ৫ বছর শাস্তি থাকছে। তবে এসব কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে ক্ষতিপূরণের জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতা থাকছে আদালতের হাতেই।

আইনটির খসড়া প্রস্তুতের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বর্তমানে ভূমি প্রতারণা ও জালিয়াতি সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। প্রতারণা-জালিয়াতির বিষয়গুলো পেনালকোডে নির্ধারিত বিধান অনুযায়ী বিচার হয়। এতে বছরের পর বছর বিচারপ্রার্থীদের সময়ক্ষেপণ হয়। অনেকে জীবন থাকতে জমিসংক্রান্ত মামলার নিষ্পত্তি দেখে যেতে পারেন না। কিন্তু প্রস্তাবিত আইনটি পাস হলে ভূমিসংক্রান্ত বিরোধের অনেক বিষয়ে দ্রুত সমাধান পাবেন। এতে ভূমিসংক্রান্ত মামলার সংখ্যা কমে আসতে পারে।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের ক্ষমতা: প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় অবৈধভাবে জমি দখল প্রতিরোধে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপক ক্ষমতার প্রস্তাব করা হয়েছে। যে বা যারা অবৈধভাবে কোনো জমি দখল করবে তাদের বিরুদ্ধে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আবেদন করতে পারবেন জমির প্রকৃত মালিক। এ ক্ষেত্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সব কাগজপত্র পরীক্ষা করে যদি অভিযোগের সত্যতা পান তাহলে দখলীয় জমি প্রকৃত মালিকের কাছে ফিরিয়ে দিতে আদেশ দেওয়াসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উভয় পক্ষের বক্তব্য গ্রহণ ও সরেজমিন তদন্ত করবেন। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের এমন পদক্ষেপে কোনো পক্ষ উপস্থিত না হলে তিনি সরেজমিন তদন্ত শেষে প্রয়োজনীয় আদেশ দিতে পারবেন। সন্তুষ্ট না হলে যে কোনো পক্ষ নিয়মিত আদালতে যাওয়ার সুযোগও থাকছে।

আইনের কঠোর এই পদক্ষেপের ক্ষেত্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের জবাবদিহি রাখারও ব্যবস্থা প্রস্তাবিত আইনে রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে, এ-সংক্রান্ত আবেদন ৩ মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে দখল পুনরুদ্ধার করতে হবে। যদি কোনো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইচ্ছাকৃতভাবে আবেদনকারীর প্রতি অবহেলা বা অসহযোগিতা করেন তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। তবে এ ধরনের বিরোধে উপযুক্ত কোনো দেওয়ানি আদালত থেকে আদেশ এলে তা প্রাধান্য পাবে।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দেওয়া আদেশ অমান্য করলে বা আদেশ বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করলে দায়ীদের দুই বছর পর্যন্ত দণ্ড দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ২০০৯ সালের মোবাইল কোর্ট আইন অনুসরণ করতে হবে। একই সঙ্গে প্রস্তাবিত আইনে সরল বিশ্বাসে কৃত কাজের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সুরক্ষার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।

ভূমি সালিশি বোর্ড: জমির ভোগদখল, সীমানা নির্ধারণ বা যৌথ সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা সম্পর্কিত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ভূমি সালিশি বোর্ড গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে আইনে। সংশ্নিষ্ট পক্ষগণের বক্তব্য এবং কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তথ্য ও প্রতিবেদন সংগ্রহ করে বিরোধ নিরসনে আদেশ দিতে পারবে বোর্ড। পক্ষগণের সম্মতিসহ বোর্ড থেকে আদেশ প্রকাশ হলে সংশ্নিষ্ট বিষয়ে বোর্ডের আদেশই চূড়ান্ত হবে। মামলার কোনো পক্ষ বোর্ডের আদেশ দেওয়া বিষয়ে কোনো দেওয়ানি আদালত বা রাজস্ব কর্তৃপক্ষের কাছে মামলা করতে পারবে না। তবে বোর্ডে আস্থা না থাকলে যে কোনো পক্ষ নিয়মিত আদালতে যেতে পারবে। অন্যদিকে যে কোনো আদালত যথাযথ মনে করলে, ভূমি নিরোধ নিরসন সংক্রান্ত বিষয় বোর্ডের কাছে পাঠাতে পারবে। কিন্তু প্রস্তাবিত খসড়া আইনে কাদেরকে দিয়ে বোর্ড গঠন করা হবে তা উল্লেখ করা হয়নি। আইনে বলা হয়েছে, ভূমি সালিশি বোর্ড গঠন, কার্যপরিধি ও অধিক্ষেত্র নির্ধারণ সরকার আদেশ দ্বারা ঘোষণা করতে পারবে।

শ্রেণি পরিবর্তনের শাস্তি: প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় ভূমির শ্রেণি পরিবর্তনসংক্রান্ত কোনো অভিযোগ জমা পড়লে ডিসি স্বীয় বিবেচনায় যে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে সেটা বন্ধ করতে পারবেন।

বায়নাকৃত জমি সম্পর্কে শাস্তি: ভূমি ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনাকালে বেআইনি দলিলের মাধ্যমে রেকর্ড হালকরণ করা যাবে না। যে বা যারা প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে এ ধরনের উদ্যোগ নেবেন তিনি আইন ভঙ্গ করার দায়ে অভিযুক্ত হবেন। একই সঙ্গে ভূমি বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে বায়নাপত্র বা অন্য কোনো দলিল হওয়ার পর, সেই দলিল বলবৎ থাকা পর্যন্ত সংশ্নিষ্ট জমি অন্য জায়গায় বিক্রি করা যাবে না। যদি কেউ এ ধরনের উদ্যোগ নেন তাহলে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

জমি ক্রয়-বিক্রয়সংক্রান্ত অপরাধ: কেউ যদি জমি বিক্রয়ের জন্য নির্ধারিত পরিমাণ টাকা গ্রহণ করার পরও ক্রেতার কাছে যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া জমি হস্তান্তর না করেন সেটা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এই অপরাধের দণ্ড রাখা হয়েছে ২ বছর পর্যন্ত। একই সঙ্গে আলোচ্য আইনের কেউ দোষী সাব্যস্ত হয়ে দণ্ডিত হওয়ার পর আবারও একই ধরনের অপরাধ সংঘটিত করে সে ক্ষেত্রে অপরাধীর শাস্তি দ্বিগুণ হবে।

জেলা প্রশাসন থেকে আদালতে তথ্য: এই আইনে উল্লেখ করা ভূমিবিষয়ক জালিয়াতি ও প্রতারণাসংক্রান্ত অপরাধের প্রতিকারের জন্য উপযুক্ত আদালতে সরাসরি মামলা করতে হবে। মামলা দায়েরের পর আদালত জেলা প্রশাসনসহ প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তথ্যউপাত্ত ও প্রতিবেদন সংগ্রহ করে রায় প্রদান করবে।

ক্ষতিপূরণ ও তথ্য সংরক্ষণ: সংঘটিত অপরাধের কারণে ব্যক্তি বা সংস্থা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে- আদালতের কাছে এমন বিষয় প্রতীয়মান হলে সংশ্নিষ্টদের বিরুদ্ধে আর্থিক ক্ষতিপূরণ আদায়ের আদেশ দিতে পারবেন। এই ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের অঙ্ক আইনে উল্লেখ করা হয়নি। অর্থাৎ সংশ্নিষ্ট অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ নির্ধারণে ক্ষমতা আদালতকে দেওয়া হয়েছে।

Share