পদ্মা সেতুর সুফল আটকে আছে কালনা সেতুতে

নয়াবার্তা প্রতিবেদক : পদ্মা সেতু উদ্বোধনে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্য জেলার মানুষের মতো বৃহত্তর যশোর জেলার মানুষ আনন্দ উৎসব পালন করেছেন, রাজধানী ঢাকায় যাতায়াতে সারা জীবনের ফেরি দুর্ভোগের মুক্তি মিলতে যাচ্ছে ভেবে এ জনপদের কোটি মানুষ খুশি। তবে পদ্মা সেতু চালু হলেও নড়াইলের মধুমতী নদীতে নির্মাণাধীন কালনা সেতু চালু না হওয়ায় মাত্র ১৩৫ কিলোমিটার দূরের যশোর জেলার মানুষ এখনও পুরোপুরি ‘সেতুর সুবিধা’ গ্রহণ করতে পারছেন না।

বিকল্প উপায়ে পদ্মা সেতু রুটে চলাচল করছেন অনেকে : নড়াইল জেলার একাংশের লোকজন ফেরিতে কালনা ঘাট পার হয়ে ভাঙ্গা-পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকায় গেলেও যশোর, নড়াইল, সাতক্ষীরা, খুলনা জেলার একাংশ, বেনাপোল ও ভারতীয় রুটের যাত্রীরা এখনো সেই আগের রুট দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে ফেরি পার হয়েই রাজধানীতে যাচ্ছেন।

তবে পদ্মা সেতুর ‘আবেগ-অনুভূতিকে’ মূল্যয়ন ও কিছু যাত্রীর চাহিদার কথা বিবেচনা করে অল্প সংখ্যক পরিবহন যশোর থেকে মাগুরা ও ফরিদপুর-ভাঙ্গা হয়ে পদ্মা সেতু পার হয়ে রাজধানীতে যাচ্ছে। এতে অনেক বেশি সময় অপচয় হচ্ছে। এছাড়া ঢাকা থেকে কলকাতাগামী বাসগুলো অধিকাংশই পদ্মা সেতু পার হয়ে গোপালগঞ্জ-খুলনা-যশোর হয়ে বেনাপোল সীমান্ত অতিক্রম করছে।

যদিও কালনা সেতু নির্মাণকারী প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা দুই মাস পরে আগামী সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে কালনা সেতু চালুর সম্ভবনার কথা জানিয়েছে। এতে অপেক্ষার প্রহর গুণছেন এ অঞ্চলের মানুষ।

অন্যদিকে শুধু কালনা সেতু চালু হলে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে এ অঞ্চলের সরাসরি সড়ক পথে যোগাযোগ স্থাপিত হলেও মাত্র ১৮ ফুট প্রশস্তের (চওড়া) বেনাপোল-যশোর-ভাঙ্গা আঞ্চলিক সড়কের কারণে ভোগান্তি বাড়ার আশংকা রয়েছে। এমনকি, দ্রুত সময়ে এই সড়ক প্রশস্তকরণের কাজ সম্পন্ন না হলে বড় বাস চলাচলে বিঘ্ন ঘটবে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, যশোর জেলা শহর থেকে নড়াইল জেলা শহরের দূরত্ব ৩৫ কিলোমিটার, এরপর ২৬ কিলোমিটার দূরে মধুমতি নদীর ওপরের কালনা সেতু পেরিয়ে পদ্মা সেতুর দূরত্ব ১০০ কিলোমিটার (নড়াইল থেকে পদ্মা সেতু)। যার ফলে যশোর থেকে পদ্মা সেতু হয়ে রাজধানী ঢাকার দূরত্ব দাঁড়াচ্ছে ১৮৬ কিলোমিটার। অথচ বর্তমানে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে ফেরি পার হয়ে ঢাকা দূরত্ব ২১২ কিলোমিটার। ফলে কালনা সেতু চালু হলে এই রুটে সরাসরি সংযোগ স্থাপনের পাশাপাশি দূরত্ব কমবে ২৬ কিলোমিটার। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় ফেরি পার হওয়ার বিলম্ব না থাকায় সাড়ে তিন ঘণ্টায় রাজধানীতে পৌঁছাতে পারবেন এ অঞ্চলের মানুষ।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পদ্মা সেতুর সঙ্গে যান চলাচলের জন্য নড়াইল ও গোপালগঞ্জ জেলার মধ্যবর্তী মধুমতী নদীর কালনা পয়েন্টে চলছে কালনা সেতু নির্মাণের কাজ। সেতুর পূর্বপাড়ে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলা এবং পশ্চিমপাড়ে নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলা। পদ্মা সেতুর সঙ্গেই এটির উদ্বোধনের প্রস্তুতি থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা দুমাস পিছিয়ে গেছে।

কালনা সেতুর প্রকল্প ব্যবস্থাপক ও সওজ নড়াইলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুজ্জামান বলেন, এ সেতুর সার্বিক কাজ হয়েছে ৯০ শতাংশ। আগামী জুলাইয়ের মধ্যেই সেতুর পুরো কাজ সম্পন্ন হবে বলে আশা করছি। সংযোগ সড়কের কাজও শেষের পথে। আগামী দশ দিনের মধ্যে সড়কের কাজও শেষ হয়ে যাবে। জুলাইয়ের শেষেই সড়কটি যান চলাচলের উপযোগী হয়ে যাবে। আর সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে উদ্বোধনের সম্ভাব্য তারিখ রয়েছে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সওজ বিভাগের ক্রসবর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় জাইকার অর্থায়নে এ সেতু হচ্ছে। জাপানের টেককেন করপোরেশন ও ওয়াইবিসি এবং বাংলাদেশের আবদুল মোনেম লিমিটেড যৌথভাবে এ সেতুর ঠিকাদার। ছয় লেনের এ সেতু হবে এশিয়ান হাইওয়ের অংশ। চারটি মূল লেনে দ্রুত গতির ও দুটি লেনে কম গতির যানবাহন চলাচল করবে।

সূত্র আরও জানায়, পদ্মা সেতু চার লেনের হলেও দেশের প্রথম ছয় লেনের সেতু হবে কালনা। পদ্মা সেতুর পাইলক্যাপ পানির ওপর পর্যন্ত। কিন্তু এ সেতুর পাইলক্যাপ পানির নিচে মাটির ভেতরে। তাই নৌযান চলাচলে সমস্যা হবে না, পলি জমবে না এবং নদীর স্রোতও কম বাধাগ্রস্ত হবে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, নদীর পূর্বপাড়ের সংযোগ সড়কের কার্পেটিং এবং পশ্চিমপাড়ে পাথর-বালু ঢালাইয়ের কাজ শেষের পথে। সংযোগ সড়কের ১৩টি কালভার্টের মধ্যে ১২টির এবং আটটি আন্ডারপাসের কাজ শেষ হয়েছে। কাশিয়ানী প্রান্তে চলছে ডিজিটাল টোলপ্লাজা নির্মাণের কাজ। সেতুর মাঝখানে বসানো হয়েছে ১৫০ মিটার দীর্ঘ স্টিলের স্প্যান। নেলসন লোস আর্চ টাইপের (ধনুকের মতো বাঁকা) এ স্প্যানটি তৈরি হয়েছে ভিয়েতনামে। তৈরি করেছে জাপানের নিপ্পন কোম্পানি। এটাই সেতুর সবচেয়ে বড় কাজ, যা বসানো শেষ হয়েছে। ওই স্প্যানটির উভয়পাশের অন্য স্প্যানগুলো পিসি গার্ডারের (কনক্রিট)।

সওজ ও পরিবহন সংশ্লিষ্টদের সূত্র মতে, এ সেতু চালু হলে বেনাপোল স্থলবন্দর থেকে যশোর হয়ে নড়াইল যাতায়াতকারী পরিবহন মাগুরা-ফরিদপুর হয়ে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া যাতায়াতের পরিবর্তে কালনা হয়ে পদ্মা সেতু দিয়ে যাতায়াত করতে পারবে। এতে বেনাপোল-ঢাকা ও যশোর-ঢাকা, খুলনা-ঢাকা এবং নড়াইল-ঢাকা, শিল্প ও বাণিজ্যিক শহর নওয়াপাড়া ও মোংলা বন্দর, সাতক্ষীরার দূরত্বও কমে যাবে।

এদিকে, কালনা সেতু চালু হলে এবং বেনাপোল-যশোর-নড়াইল-ভাঙ্গা সড়কের প্রশস্তকরণ করা হলে রাজধানী ঢাকার সাথে এ অঞ্চলের মানুষের নির্বিঘ্ন যোগাযোগ স্থাপিত হবে। এতে যশোরে উৎপাদিত তাজা সবজি, ফলমুল, মাছ ও গদখালীর সতেজ ফুল ভোগান্তি ছাড়াই তিন ঘণ্টার মধ্যেই রাজধানীর বাজারে তুলতে পারবে। একইসাথে, বেনাপোল ও নওয়াপাড়া শিল্প এলাকার পণ্যবাহী ট্রাকগুলো দ্রত ঢাকায় পৌঁছাতে পারবে। সেই সঙ্গে ঢাকা থেকে কলকাতাগামী মানুষেরাও দ্রুত গন্তেব্যে পৌঁছাতে পারবেন।

Share