নয়াবার্তা প্রতিবেদক : পালানোর সময় সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান গ্রেপ্তার হয়েছেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মো. মাইনুল হাসান মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর জানান, রাজধানীর নিউমার্কেট থানার একটি মামলায় এই দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি চলাকালে গত ১৬ জুলাই ঢাকা কলেজের সামনে সংঘর্ষে দুজন নিহত হন। তাঁদের একজন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী সবুজ আলী (২৬) এবং অন্যজন হকার মো. শাহজাহান (২৬)। এ ঘটনায় নিউমার্কেট থানায় দুটি হত্যা মামলা হয়েছে। এসব হত্যার ঘটনায় ইন্ধনদাতা হিসেবে আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
মঙ্গলবার রাতে ডিএমপির জনসংযোগ বিভাগ থেকে পাঠানো একটি খুদে বার্তায় বলা হয়েছে, নৌপথে পালিয়ে যাওয়ার সময় ঢাকার সদরঘাট এলাকা থেকে আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমানকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য ও আওয়ামী লীগের নেতারা আত্মগোপনে রয়েছেন। কেউ কেউ দেশ ছেড়েছেন বলে খবর এসেছে। এর মধ্যে আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমানকে গ্রেপ্তারের কথা জানাল পুলিশ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি ছিলেন আইনজীবী আনিসুল হক। ২০১৪ সালের নির্বাচনে তাঁকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (আখাউড়া ও কসবা) আসন থেকে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর শেখ হাসিনা তাঁকে আইনমন্ত্রী নিয়োগ দেন। সেই থেকে তিনি আইনমন্ত্রীর পদে ছিলেন।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দুটি বিতর্কিত বক্তব্য দেওয়ার পর সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে অনেকটা নিষ্ক্রিয় করে সামনে আনা হয় আনিসুল হক ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাতকে।
ওবায়দুল কাদের ১৫ জুলাই বলেছিলেন, আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ স্লোগানের জবাব ছাত্রলীগই দেবে। তারা প্রস্তুত। ১৯ জুলাই কারফিউ জারি করার বিষয়টি জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘শুট অন সাইট’ বা দেখামাত্র গুলির নির্দেশ জারি করা হয়েছে।
২০ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম দুই সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহ এবং সহসমন্বয়ক হাসিব আল ইসলাম ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী এবং সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাতের কাছে দাবি তুলে ধরেন।
আনিসুল হক আইনমন্ত্রী থাকার সময় ২০১৮ সালে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হয়, যা পরে রহিত করা হয়। ২০২৩ সালে করা হয় নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইন। এ আইনের বিভিন্ন ধারা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। আনিসুল হকের আমলে মাঠের বিরোধী দলগুলোর নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ‘গায়েবি’ মামলা এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক মামলায় তড়িঘড়ি করে বিচার শেষ করার পদক্ষেপ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
আনিসুল হক গত ২৫ জানুয়ারিতে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, পুলিশ অভিযোগপত্র দিয়ে মামলা আদালতে আনতে যে সময়টা পার হয়েছে, এর সঙ্গে কাকতালীয়ভাবে মিলে গেছে নির্বাচনের সময়। সরকারের আমলে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বাক্স্বাধীনতা ক্ষুণ্নের বিষয়ে তিনি আরও বলেছিলেন, মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের কনসেপ্ট (ধারণা) কিন্তু স্থিতিশীল কিছু নয়। এগুলো সব সময় পরিবর্তন হচ্ছে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যেখানেই আরও উন্নত বা ভালো করা প্রয়োজন, সেটা সরকার করবে।
সালমান এফ রহমান
সালমান এফ রহমান বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি এবং বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। তিনি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন।
২০১৮ সালের নির্বাচনে সালমান এফ রহমান ঢাকা-১ আসন থেকে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য হন। পরে তাঁকে নিজের বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সালমান এফ রহমান আশির দশক থেকেই শীর্ষস্থানীয় একজন ঋণখেলাপি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে তাঁর নাম এসেছিল। তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ সুবিধা নিয়ে ঋণখেলাপির তালিকা থেকে নাম কাটায়।
২০১১ সালে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির পর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি বলেছিল, নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে সালমান এফ রহমানের ভূমিকা রয়েছে। তাঁকে শেয়ারবাজার থেকে দূরে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েকটি প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গ্রুপের চাপে বৃহৎ ঋণ পুনর্গঠনের একটি নীতিমালা তৈরি করে দেয়। ওই নীতিমালার আওতায় সুবিধা পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি বেক্সিমকো গ্রুপ।
২০১৬ সালের আগস্টে সালমান এফ রহমান ও তাঁর ভাই আহমেদ সোহেল ফশিউর রহমানের (এ এস এফ রহমান) ধানমন্ডির বাড়ির নিলামের উদ্যোগ নিয়েছিল সোনালী ব্যাংক। তারা বেসরকারি বিমান পরিবহন সংস্থা জিএমজি এয়ারলাইনসের কাছে ২২৮ কোটি টাকা আদায়ের জন্য এ নিলামের আয়োজন করে। তবে আগের দিন নিলাম আটকে যায়।
সালমান এফ রহমান ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আগে দেওয়া হলফনামায় নিজের অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ দেখান ৩১২ কোটি টাকার বেশি। পাঁচ বছরে তাঁর অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ৩৬ কোটি টাকা।
বিভিন্ন ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো ও তাঁর স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে ৫০ হাজার কোটি টাকার মতো ঋণ রয়েছে।