প্রায় দেড় বছর পর আজ খুলছে স্কুল-কলেজ, মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধিসহ নানা নির্দেশনা

নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : টানা প্রায় ১৮ মাস বন্ধের পর আজ রবিবার খুলছে দেশের সব স্কুল ও কলেজ। এ কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে চলছে উৎসবের আমেজ। শিক্ষক ও কর্মচারীরা শিক্ষার্থীদের বরণ করে নিতে প্রস্তুত। স্কুলে যেতে প্রস্তুত শিক্ষার্থীরাও। তবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস থাকলেও কোনো কোনো অভিভাবকের মধ্যে ভর করেছে আতঙ্কও।

করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর আজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসবে শিক্ষার্থীরা। অনেক শিক্ষার্থী; যারা নতুন ভর্তি হয়েছে, তাদের জন্য আজই হবে স্কুল-কলেজের প্রথম দিন। এ জন্য অনেক স্কুলের ফটক সাজানো হয়েছে। কোনো কোনো স্কুল ড্রাম বাজিয়ে, করতালি দিয়ে শিক্ষার্থীদের বরণ করে নেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে বলে জানা গেছে। শিক্ষকেরা জানিয়েছেন, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার জন্য ১৯ দফা নির্দেশনা দিয়েছিল। সে আলোকই প্রস্তুত হয়েছে স্কুলগুলো।

গত বছরের ৮ মার্চ দেশে করোনা ভাইরাসের অস্তিত্ব শনাক্ত হয়। ঐ বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। এরপর সংক্রমণ পরিস্থিতির বিশেষ উন্নতি না হওয়ায় দফায় দফায় ছুটি বাড়ানো হয়। চলতি বছরের শুরুর দিকে সংক্রমণ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও কয়েক দফা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সবশেষ করোনা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ১২ সেপ্টেম্বর থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানান। তবে বিশ্ববিদ্যালয় খুলবে আগামী মধ্য অক্টোবরে।

যারা যাবে, যারা যাবে না: আজ স্কুল-কলেজ খুললেও সব শিক্ষার্থী একসঙ্গে যাবে না। শুধু ২০২১ ও ২০২২ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী এবং পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন (সপ্তাহে ছয় দিন) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাবে। এদের সঙ্গে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণির মধ্যে যে কোনো একটি শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পর্যায়ক্রমে এক দিন করে যাবে। দুটি করে ক্লাস ধরে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে রুটিন তৈরি করেছে।

তবে স্কুল খুললেও কোনো অ্যাসেম্বলি হবে না। পড়াশোনায় কোনো চাপও থাকবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দুই মাসের মধ্যে কোনো ধরনের মূল্যায়ন ও আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা না নেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বা দেহে কোনো ধরনের উপসর্গের কারণে যদি শিক্ষার্থীরা সশরীরে উপস্থিত হয়ে ক্লাসে যোগদান করতে না পারে, তাহলে (যথোপযুক্ত প্রমাণ সাপেক্ষে) তাদের অনুপস্থিত হিসেবে গণ্য করা হবে না। সবাইকে মাস্ক পরে স্কুলে আসার নির্দেশনা রয়েছে। আবার মাস্ক পরার কারণে কোনো শিশু শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়ে কি না, সে বিষয়েও শিক্ষকদের দৃষ্টি রাখতে বলা হয়েছে।

শিক্ষার্থী বরণে প্রস্তুতি: প্রতিষ্ঠান খোলার প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের আনন্দঘন পরিবেশে শ্রেণি কার্যক্রমে স্বাগত জানানোর জন্য স্কুলগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে শিক্ষা বিভাগের পক্ষ থেকে। সেই আলোকে নানা প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ শিক্ষার্থীদের বরণ করে নেওয়ার জন্য নানা প্রস্তুতি নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ অধ্যাপক কামরুন নাহার জানান, শিক্ষার্থীরা যখন কলেজ ক্যাম্পাসে প্রবেশ করবে, তখন হাততালি দিয়ে তাদের বরণ করে নেওয়া হবে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের গেট ও শ্রেণিকক্ষ বেলুন দিয়ে সাজানো হয়েছে। সবকিছুই স্বাস্থ্যবিধি মেনে হবে। রাজধানীর মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের রূপনগর শাখার প্রধান সাইদা নারগীস বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের বরণ করে নেওয়ার জন্য স্কুল পুরোপুরি প্রস্তুত রয়েছে।’

শঙ্কায় অভিভাবকেরা: করোনার সংক্রমণ ৫ শতাংশের নিচে নামলেই স্কুল খোলা যাবে, আন্তর্জাতিকভাবে এমন একটি স্বীকৃতি রয়েছে। কিন্তু দেশে সংক্রমণ ১০ শতাংশের নিচে নামার পরপরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া সব শিক্ষক-কর্মচারী ও শিক্ষার্থী এখনো টিকার আওতায় আসেনি। তথ্য অনুযায়ী, সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ শিক্ষক-কর্মচারী টিকা নিয়েছেন। ফলে এদিক থেকে কিছুটা শঙ্কা রয়েছে। এছাড়া যারা এইচএসসি পরীক্ষার্থী তাদের বয়স ১৮ বছরের বেশি হয়েছে। এসব শিক্ষার্থীও টিকা পাননি। এসব শিক্ষার্থী একে অপরের সংস্পর্শে আসবেন। ফলে কিছুটা হলেও ঝুঁকি থেকে যায়। এসব নিয়ে চিন্তিত কোনো কোনো অভিভাবক।

তৌহিদ আজিজ নামে একজন অভিভাবক বলেন, ‘স্কুল খুললেও আমার সন্তানকে পাঠাতে দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছে। একদিকে সন্তানের ভবিষ্যত্, অন্যদিকে সন্তানের জীবনের প্রশ্নও এসে যাচ্ছে। সবকিছু ছাপিয়ে করোনার সংক্রমণ আরো যদি কমে যায়, তখনই অভিভাবকদের মধ্যে আস্থা তৈরি হবে।’ অভিভাবকেরা জানান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। ঠিকমতো আঙিনা ও আশপাশের পানি পরিষ্কার না করা হলে শিক্ষার্থীরা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে পারে। এ ভয়টিও অভিভাবকদের ভাবিয়ে তুলছে।

প্রাথমিক স্কুলের জন্য ১৬ দফা নির্দেশনা: প্রাথমিক স্কুলগুলো কীভাবে চলবে এ-সংক্রান্ত ১৬ দফা নির্দেশনা প্রকাশ করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। শুক্রবার এই নির্দেশনা জারি করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে :দৈনিক সমাবেশ বন্ধ রাখতে হবে। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে নিরাপদ দূরত্ব রেখে নিজেদের আসনে বসে হালকা শারীরিক কসরত্ (পিটি) করবে। কেউ প্রয়োজন মনে করলে পিটি করা থেকে বিরত থাকতে পারবে।

শিক্ষার্থীরা জিগজ্যাগ তথা জেড বিন্যাসে বসবে। প্রতি বেঞ্চে এক জনের বেশি বসবে না। একই দিনে একই সময়ে সর্বোচ্চ দুটি শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে আসার ব্যবস্থা রেখে টিফিন বিরতি ছাড়া শ্রেণি কার্যক্রম চলবে। সর্বোচ্চ ৩ ঘণ্টার মধ্যে শ্রেণি কার্যক্রম শেষ করতে হবে।

শ্রেণি কার্যক্রমে গ্রুপ ওয়ার্ক ও পেপার ওয়ার্কের মতো সম্ভাব্য স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টিকারী শিখন কাজ আপতত বাদ রাখতে হবে। শিক্ষকেরা মাস্ক পরে ক্লাস নেবেন। শিক্ষার্থীদেরও মাস্ক পরা নিশ্চিত করবেন তিনি। ক্লাস শেষে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সারিবদ্ধভাবে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয় ত্যাগ নিশ্চিত করতে হবে। সব শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের একত্রে শ্রেণিকক্ষ ত্যাগ করতে দেওয়া যাবে না। একাধিক শিফটে ক্লাস চললে আগের শিফট ও পরের শিফটের ক্লাস শুরুর মাঝে অন্তত ৩০ মিনিটের বিরতি রাখতে হবে। শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ পানির বোতল নিয়ে বিদ্যালয়ে আসবে।

যেভাবে শ্রেণিকক্ষে বসতে হবে: বেঞ্চের দৈর্ঘ্য ৫ ফুটের কম হলে প্রতিটি বেঞ্চে এক জন করে বসবে। কমপক্ষে একটি বেঞ্চ অন্তর অন্তর ৩ ফুট দূরত্ব নিশ্চিত করতে হবে। যদি বেঞ্চগুলো সরিয়ে ফেলার পর্যাপ্ত জায়গা না থাকে, সেক্ষেত্রে দ্বিতীয় ও চতুর্থ বেঞ্চে ক্রস (X) মার্ক করে দিতে হবে, যাতে সেখানে কোনো শিক্ষার্থী বসতে না পারে। যদি বেঞ্চের দৈর্ঘ্য ৫ ফুট বা তার বেশি হয়, তবে প্রতিটি বেঞ্চে দুই জন করে বসতে পারবে।

এছাড়া মহামারি পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গভর্নিং বডি, ম্যানেজিং কমিটি, অভিভাবক, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, প্রতিষ্ঠানপ্রধান, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, আঞ্চলিক উপপরিচালক, আঞ্চলিক পরিচালকদের ৬৩টি নির্দেশনা দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)।

Share