বন্ধের মধ্যে ঢাকায় নারীর প্রতি সহিংসতায় ২৮ মামলা

নিজস্ব বার্তা প্রতিবেদক : করোনাভাইরাসের বিস্তারের মধ্যেই গত ১০ দিনে ঢাকা মহানগরে ধর্ষণ, যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন ও অপহরণের ২৮টি মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন ৩৭ জন। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

মামলার কাগজপত্র এবং মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য সরকারি সিদ্ধান্তে ঢাকা মহানগরসহ সারা দেশের মানুষ ঘরে অবস্থান করছেন। এই সময়ের মধ্যে ঢাকা মহানগর এলাকায় ২৬ মার্চ থেকে আজ শনিবার (৪ এপ্রিল) পর্যন্ত ৯টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। আর যৌতুকের জন্য নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৮টি। এর বাইরে যৌন নিপীড়নের অপরাধে মামলা হয়েছে ৬টি। আর অপহরণের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৫টি।

জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী মনে করেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর সরকারি সিদ্ধান্তে মানুষ এখন ঘরে বন্দী। অঘোষিত লকডাউনের এই সময় নারী ও শিশু নির্যাতন অনেক গুণ বেড়ে গেছে। কিন্তু সেই চিত্র তেমনভাবে উঠে আসছে না। অবশ্য ভুক্তভোগী অনেক নারী থানায় মামলা করছেন। এই সময়ে তাঁদের কাছেও অনেক ভুক্তভোগী নারী অভিযোগ জানাচ্ছেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের সমন্বয়ক চিকিৎসক বিলকিস বেগম আজ শনিবার বলেন, করোনাভাইরাসের এই মহামারির সময় প্রতিদিনই দুই থেকে চারজন ভুক্তভোগী নারী ও শিশু ওসিসিতে সেবা নিতে আসছে। আজ শনিবারও তিনজন ভুক্তভোগী নারী এসেছেন। ভুক্তভোগীদের মধ্যে কেউ ধর্ষণের শিকার, কেউবা যৌন নিপীড়নের। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর কারণে ভুক্তভোগীদের বেশি দিন ওসিসিতে ভর্তি রাখা হচ্ছে না। ইতিমধ্যে পুলিশকে জানানো হয়েছে যে বহির্বিভাগে যেন ভুক্তভোগীদের পরীক্ষা করানো হয়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অপরাধ ও তথ্য বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) জাফর হোসেন বলেন, ‘করোনাভাইরাসের এই সময় যারা অপরাধের সঙ্গে জড়াচ্ছে, তাদের পুলিশ গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠাচ্ছে। নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলার আসামিদেরও গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হচ্ছে।’

করোনাভাইরাসের মহামারির এই সময়ে দেশে দেশে লকডাউন চলছে। মানুষ ঘরবন্দী। ভারতের সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি গতকাল জানিয়েছে, করোনাভাইরাসের এই সময় ভারতে নারী নির্যাতন বেড়েছে।

মামলার এজাহারের তথ্য বলছে, ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায় মা–বাবার সঙ্গে বাস করে ১০ বছর বয়সী শিশু। গত বৃহস্পতিবার (২ এপ্রিল) রাতে শিশুটি মোহাম্মদপুরের টাউন হল থেকে হেঁটে বাসায় ফিরছিল। তখন জাকির হোসেন (২৪) ওই শিশুটিকে জোর করে রিকশায় ওঠানোর চেষ্টা করে। এই সময় শিশুটির চিৎকার শুনে টহল পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে আসামি জাকিরকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে। ভুক্তভোগী শিশুটি গতকাল ঢাকার সিএমএম আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২২ ধারায় জবানবন্দি দেয়।

গত বৃহস্পতিবার ২৮ বছর বয়সী এক নারী যাত্রাবাড়ী থানায় হাজির হয়ে অভিযোগ করেন, তাঁর স্বামী শরিফুল ইসলামসহ তিনজন মিলে যৌতুকের জন্য শারীরিকভাবে নির্যাতন করেন। পরে তিনি কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা করেন। লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পর যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ শরিফুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে ঢাকার আদালতে পাঠায়।
নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার ভুক্তভোগীদের পক্ষে কাজ করা মানবাধিকার সংগঠন এবং অপরাধবিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, যেকোনো দুর্যোগের সময় অপরাধের হার অনেক গুণ বেড়ে যায়। এর সঙ্গে বাড়ে নারী ও শিশু নির্যাতনও।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান জিয়া রহমান প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো ক্রাইসিসের সময় অপরাধ বেড়ে যায়। বেড়ে যায় পারিবারিক সহিংসতাও। করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে বিশ্বে মৃত্যুর হার বেড়ে চলেছে। চলছে লকডাউন। সব মানুষ এখন ঘরে। মানুষ দীর্ঘ সময় কাছাকাছি অবস্থান করছেন। বেকারত্ব বাড়ছে, বাড়ছে উদ্বেগ। নানা কারণে নারী ও শিশুরা ঘরে-বাইরে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

জিয়া রহমান জানান, করোনা ভাইরাসের এই সংকটময় অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনোযোগ অন্যদিকে। যে কারণে অপরাধীদের তৎপরতা বাড়ছে। রাস্তাগুলো ফাঁকা। এই সময় নারী ঘরের বাইরে শ্লীলতাহানির শিকার হচ্ছেন। করোনাভাইরাসের এই সংকট যদি দীর্ঘ সময় থাকে, তাহলে অপরাধ আরও বেড়ে যাবে। এখনই এই বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। নিতে হবে দীর্ঘ পরিকল্পনাও।

জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী বলেন, করোনাভাইরাসের বিশেষ সময়ে ঘরের ভেতর নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। যৌতুকের দাবিতে নারীদের নির্যাতন করা হচ্ছে। নারী ও শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আবার নির্যাতনের শিকার হয়েও অনেক ভুক্তভোগী ঘরের বাইরে যেতে পারছেন না। থানায় দিতে পারছেন না অভিযোগ। এই বিষয়গুলো সবাইকে মাথায় রাখতে হবে। এখনই নিতে হবে পদক্ষেপ।

Share