বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তে উত্তেজনা প্রশমনে বিশ্বকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে

ড. অর্পিতা হাজারিকা : রোহিঙ্গা সংকটের শুরু থেকে মিয়ানমার বিষয়টিকে প্রায় শেষ করে এনেছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জাতিনিধন অভিযান শুরুর পর থেকে গণহত্যার শিকার এই সম্প্রদায় বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বিশ্ব নেতাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। তারপর থেকে একজনও রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেয়নি মিয়ানমার।

এতসব সত্ত্বেও বাংলাদেশের সঙ্গে এখন সংঘাত চাইছে মিয়ানমার। এর অংশ হিসেবে বাংলাদেশের ভিতরে তারা মর্টার শেল নিক্ষেপ করেছে। এতে একজন রোহিঙ্গা বালক নিহত হয়েছে। এর আগে বান্দরবানের নাক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে স্থল মাইন বিস্ফোরণে আহত হয়েছেন এক বাংলাদেশী যুবক। শুক্রবার বিকেলে ঘুমধুম উপজেলা সীমান্তে সর্বশেষ বিস্ফোরণ হয়।

রোহিঙ্গা সংকটের শুরুতে সীমান্তে বেশ কয়েকবার উস্কানি দিয়েছে মিয়ানমার। ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে বাংলাদেশ। মিডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী এখন তারা আবার বাংলাদেশের ভিতরে মর্টার শেল নিক্ষেপ করছে এবং হেলিকপ্টার ব্যবহার করছে।

এ অবস্থায় সর্বোচ্চ ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড বাহিনী।
আমরা মনে করি যে রোহিঙ্গা সংকট শুরু থেকে মিয়ানমারের নৃশংসতা ও চরমপন্থার বিরুদ্ধে মানবিকতা দেখিয়ে আসছে বাংলাদেশ। আইন অনুযায়ী পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের পরিবর্তে এই নতুন উস্কানি কোনোভাবেই গ্রহণযেগ্য নয়। তাই মিয়ানমারকে এখনই থামাতে অবশ্যই কঠোর অবস্থান নেয়া উচিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের।

শুরু থেকেই আমরা বলে আসছি রোহিঙ্গা সংকট মিয়ানমারের সৃষ্টি। তাদেরকেই এর সমাধান করতে হবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ঢিলেমির কারণে মিয়ানমারের ঔদ্ধত্য ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের ভিতরে মর্টার শেল নিক্ষেপ, সীমান্তে স্থল মাইন পেতে রাখা এবং হেলিকপ্টার থেকে গোলা নিক্ষেপ কোনোভাবেই প্রতিবেশীসুলভ আচরণ নয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আমাদের আহ্বান মিয়ানমারের কাছে কঠোর কূটনৈতিক বার্তা পাঠান এবং সীমান্ত এলাকায় স্থানীয় মানুষদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। এমনকি এই ইস্যুটি জাতিসংঘ পর্যন্ত তুলুন।

রোহিঙ্গা সংকটের শুরু থেকেই মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কথা বলে আসছে জাতিসংঘ। কিন্তু তাতে ব্যবহৃত শব্দ শব্দই থেকে যাচ্ছে। মিয়ানমারের জেনারেলদের অমানবিক কর্মকাণ্ড বন্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি আন্তর্জাতিক এই সংগঠন। মিয়ানমারের জনগণের ওপর সেনাবাহিনীর চালানো নিষ্পেষণের প্রেক্ষিতে তাদের কাছে অর্থ ও অস্ত্রের প্রবাহ বন্ধ করতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস।

নির্বিচারে হত্যা এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে অভিযুক্ত করেছে জাতিসংঘ। মিডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে তারা যুদ্ধে লিপ্ত। মর্টার শেল এবং স্থল মাইন বিস্ফোরণে বান্দরবান সীমান্তে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। জবাবে সামরিক জান্তা বলেছে, তারা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, যারা দেশের ক্ষতি করতে চায়। মিয়ানমার যা বলছে তা হলো তাদের এই উস্কানি হলো পাল্টা জবাব। তাদের দেশের ভিতরে যা ইচ্ছা তাই ঘটুক। তা নিয়ে বাংলাদেশ উদ্বিগ্ন নয়। তাদের এই যুদ্ধ তাদের সীমান্তের ভিতরে সীমিত থাকতে হবে। পরিবর্তে ওইসব মর্টার শেল এবং বুলেট যখন বাংলাদেশের ভিতরে এসে পড়ছে তখন বলা যায় এটা হলো আন্তর্জাতিক আইনের পরিষ্কার লঙ্ঘন। এর প্রেক্ষিতে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ধৈর্য্য দেখিয়েছে।

পররাষ্ট্রনীতির অধীনে প্রতিবেশী কোনো দেশ বা অন্য কোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের শত্রুতা নেই। এ জন্যই বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, মিয়ানমার ইস্যুতে যুদ্ধ চায় না বাংলাদেশ। তারা একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়। প্রয়োজনে তারা জাতিসংঘে রিপোর্ট করবে। মিয়ানমারের বুলেট তাদের সীমান্তের ভিতরে থাকা উচিত। এ ইস্যুতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যায়ে সতর্কতা দিয়েছে বাংলাদেশ। কোনো উস্কানিতে যুদ্ধে জড়াবে না বাংলাদেশ। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক অফিসের কথা অনুযায়ী, আমরা বলতে চাই অর্থপূর্ণ এবং স্থিতিশীল উপায়ে দেশ চালাতে ব্যর্থ হয়েছে মিয়ানমারের জেনারেলরা। এ জন্য মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে আরও নিঃসঙ্গ করে দেয়া উচিত। মিয়ানমারের জনগণকে সমর্থন দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ক্ষমতার সবটুকুই করা উচিত। একই সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে আর্থিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার আহ্বান সাড়া দেয়া উচিত।

কিন্তু মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠতা আছে চীন, রাশিয়া ও ভারতের সঙ্গে। এটাই তাদেরকে নিঃসঙ্গ করে দেয়ার ক্ষেত্রে বাধা। জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস বলেছে, মিয়ানমারকে যুদ্ধবিমান এবং সশস্ত্র যান সরবরাহ করেছে রাশিয়া। যুদ্ধবিমান এবং সামরিক পরিবহন বিমান সরবরাহ করেছে চীন। রকেট এবং সামরিক গোলাবারুদ সরবরাহ দিয়েছে সার্বিয়া। প্রত্যন্ত অঞ্চলে একটি আকাশ প্রতিরক্ষা স্টেশন নির্মাণে সহায়তা করেছে ভারত। এসব দেশের ভেটোর কারণে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারবে না জাতিসংঘ।

আমরা মনে করি, উল্লেখিত ওই তিনটি দেশই বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ মিত্র। মিয়ানমারের সঙ্গে তাদের বন্ধুত্বের বিষয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই বাংলাদেশের। তবে ওইসব দেশের সমর্থনকে ব্যবহার করে মিয়ানমার সৃষ্টি করেছে রোহিঙ্গা সংকট। সম্প্রতি তারা যুদ্ধের যে উস্কানি দিচ্ছে তা বাংলাদেশের জনগণ মেনে নেবে না। যেহেতু এ দেশের জনগণের চীন, ভারত ও রশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে, তাই তাদের উচিত বাংলাদেশ ইস্যুতে মিয়ানমারকে একটি কঠিন বার্তা দেয়া। তাই যদি ঘটে, তাহলে জাতিসংঘ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারবে। তাই আমরা সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের কাছে প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানাচ্ছি।

(ইউরেশিয়া রিভিউয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের অনুবাদ)

Share